ঢাকাবুধবার , ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ
  3. অর্থনীতি
  4. আর্ন্তজাতিক
  5. ইসলাম
  6. ক্রিকেট
  7. খুলনা
  8. খেলাধুলা
  9. চট্রগ্রাম
  10. জাতীয়
  11. জানা অজানা
  12. টিপস
  13. ঢাকা
  14. তথ্য ও প্রযুক্তি
  15. দুর্ঘটনা
সর্বশেষ সবখবর

ঐতিহাসিক উপন্যাস আবাদে মক্কা

বর্ণমেলা নিউজ
সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২ ৬:৩৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ফরাজী জুলফিকার হায়দার:

Advertisements

যাহা সত্য পৃথিবীতে যতগুলি প্রাচীন জনপদ, নগর-নগরী এবং যত স্থাপত্য আছে যেমন মক্কা, কাবা, নালন্দা, তক্ষশীলা, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, ব্যাবিলন, গ্রিক, কায়রো, পিরামিড, চীনের প্রাচীর, ডায়না দেবীর মন্দির, ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান; ইহাদের মধ্যে জনপদ ও নগরী হিসাবে মক্কা এবং স্থাপত্য হিসাবে কাবা বা বাইতুল্লাহ যে সব চাইতে প্রাচীন, ইহাতে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নাই।
এই সমস্ত জনপদ, নগর-নগরীগুলির অধিকাংশই গড়িয়া উঠিয়াছিল বিশেষ কোন একটি সভ্যতাকে কেন্দ্র করিয়াই। কিন্তু ইহাদের অধিকাংশই আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হইয়াছে। কালচক্রের নিষ্ঠুর পেষণের হাত হইতে রক্ষা পায় নাই নালন্দা, তক্ষশীলা, বিলীন হইয়াছে। ধ্বংস-স্তূপে পরিণত হইয়াছে হরপ্পা, মহোঞ্জোদারো। দুর্যোগের করালগ্রাসে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে ব্যাবিলন। এই সমস্ত সভ্যতার লিলাভূমিগুলি এখন প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় হইয়া রহিয়াছে।
হিসাব করিলে দেখা যায় যে, ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদগুলি, আজো টিকিয়া গ্রিক, কায়রো, দাঁড়াইয়া থাকা স্থাপত্য চীনের প্রাচীর, ডায়না দেবীর মন্দির, ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান, পিরামিড কোনটির বয়সই তিন হাজার হইতে সাড়ে চারি হাজার বৎসরের বেশি নয়।
কিন্তু আমাদের স্থাপত্য কাবা বা বাইতুল্লাহ এবং আমাদের মক্কা কালচক্রের সমস্ত নিষ্ঠুর পেষণ, দুর্যোগের সমস্ত ঘনঘটাকে উপেক্ষা করিয়া আজও টিকিয়া আছে। বরং যাহারা ইহাকে ধ্বংস করিতে আসিয়াছে, ধ্বংস হইয়াছে তাহারাই।
আমাদের কাবা এবং মক্কার বয়স কত? নালন্দা, হরপ্পা, তক্ষশীলা এবং মহেঞ্জোদারোতে যাহারা বাসা করিত, তাহারা দেখিয়া গিয়াছে আমাদের দ্বারা আমাদের মক্কা, চীনের প্রাচীর, ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান, ডায়না দেবীর মন্দির যাহারা নির্মাণ করিয়া ছিল, তাহারা এই সবের শীর্ষদেশে দাঁড়াইয়া দেখিল, তাহাদের জন্মের বহু হাজার বৎসর আগে হইতেই কাবা এবং মক্কা বিদ্যমান।
৪৬৪৬ বৎসর পূর্বে রাজা খুকু পিরামিড নির্মাণ কার্য্য সমাপ্ত করিয়া তাহার চূড়ায় দাঁড়াইয়া দক্ষিণ পূর্ব দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহার ৭৭৫ বৎসর পূর্বে হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাবা পুনঃনির্মাণ শেষ করিয়াছেন।
তাহারও ১৩০২ বৎসর পূর্বে হযরত নূহ (আ.) দেখিলেন, তাঁহার জন্মের ১০৫৬ বৎসর পূর্বে হযরত আদম (আ.) কাবা বা বাইতুল্লাহ নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন। গোড়াপত্তন করিয়া গিয়াছেন আমাদের মক্কার। এই তো হইল আমাদের কাবা এবং মক্কার বয়স।
এখন যাহারা বলেন, দেখিয়া যাও, আমাদের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং কত উঁচা, আমাদের গ্রিক সভ্যতা কত প্রাচীন! তাহারা বরং আসিয়া দেখিয়া যাউক, আমাদের স্থাপত্য কাবা কত প্রাচীন, আমাদের নগরী মক্কা কত পুরাতন।
এই প্রাচীন স্থাপত্য কাবা আমাদের গর্ব, এই পুরাতন মক্কা আমাদের গৌরব। ইহাদের প্রতিষ্ঠাদের বাস্তবতার সাথে আবেগ মিশাইয়াই বক্ষ্যমান উপন্যাস
আবাদে মক্কা।


আওয়ালা বাইতিন ৩ : ৯৬
ওরে ভবের কুল ইনছান,
খুলে দেখ আল কোরান
বলে কিবা হু গাফফার!
এই জগতে সবার আগে
হইল নির্মাণ ঘর আল্লার!!
এই মাটিতে সুনিশ্চয়,
হইল তৈয়ার যেই নিলয়
সবার আগে যে-ই বা ঘর!
লোকের জন্য হইল পত্তন-
ঘর তাহা সেই আল্লাহর!
হয় যাহা সেই আল মক্কাতে
বাইতুল্লাহ বা ঘর কাবার!! ঐ
বরকত এবং রহমতের
ঘর তাহা সেই আল্লাহের,
তার উছিলায় মক্কা ধাম!
বরকত এবং হয় রহমতের
বিশ^ জোড়া তার সুনাম।
এই বায়তুল্লাহ জগৎ জুড়ে
দেখায় দিশা দ্বীন পাওয়ার!!ঐ
আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করিবার অপরাধে বেহেস্তের বাগান হইতে বহিষ্কৃত হইয়া, লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাই! কোথায় মুখ লুকাই! করিতে করিতে হযরত আদম (আ.) গেলেন শ্রীলঙ্কায়, আর বিবি হাওয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া গেলেন জেদ্দায়।
সৃষ্টির পর হযরত আদম ও বিবি হাওয়া বেহেশতের অপরিসীম সুখ ও আনন্দে দিন যাপন করিতে লাগিলেন। এ সুখের মাঝেই ঘনিয়া আসিল বিপদের ঘনঘটা। শয়তানের প্ররোচনায় পড়িয়া তাঁহারা আল্লাহর নির্দেশের কথা ভুলিয়া গেলেন। গন্দম খাইবার পরই তাহাদের চৈতন্য হইল। অনুতাপে দগ্ধ হৃদয়ে উভয়েই ক্ষমা প্রার্থনার ছিজদায় লুটাইয়া পড়িলেন। আল্লাহর হুকুম হইল দুনিয়ায় অবতরণ করার। অনুতপ্ত ও লজ্জিত বিশে^র প্রথম মানব আদম অবতরণ করলেন বর্তমান শ্রীলঙ্কায় আর প্রথম মানবী বিবি হাওয়া জেদ্দার উষর মরুতে পা রাখলেন।
শুরু হইল তাঁহাদের অনুশোচনা আর পরস্পরকে অনুসন্ধান। অনুশোচনার সন্তাপ, মর্মযাতনা আর লজ্জা মনের অবনত কারণে ৪০ দিন পর্যন্ত কেহ কোন আহার্য্য গ্রহণ করেন নাই। খেদানলের তাপে কালো হইয়া গেলেন তাহারা।
দুইশত বৎসর পর্যন্ত অনুশোচনা আর অনুসন্ধান করিতে করিতে ৯ই জিলহজ আরাফাতের ময়দানে তাহাদের দেখা হইয়া গেল। হযরত আদম (আ.) চিনিতে পারিলেন বিবি হাওয়াকে। বিবি হাওয়াও চিনিতে পারিলেন তাহার স্বামী হযরত আদম (আ.)কে। হইল তাহাদের পুনঃপরিচয়। এই জন্যই এই ময়দানের নাম হইল ‘আরাফাত’ বা পরিচিতি।
পরিচয়ের পর তাহারা বসিয়া গেলেন আল্লাহর দরবারে তওবা এবং ইছতিগফার করিতে। আল্লাহ মেহেরবান তাহাদের তওবাও কবুল করিলেন, ক্ষমাও করিলেন। তাহাদের চেহারাও হইয়া গেল আগের মতই সুন্দর।
এই জন্যই প্রতি বৎসর ৯ই জিলহজ বিশ^ মুসলেমীন আরাফতে সমবেত হইয়া আল্লাহর দরবারে তওবা এবং ইছতিগফার করিয়া থাকেন।
স্বীয় ভুলের ক্ষমাপ্রাপ্তির পর হযরত আদম (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিলেন, তিনি বেহেস্তে থাকাকালে যে ঘরে এবাদত করিতেন এবং তোয়াফ করিতেন, তেমন একটি ঘর যেন তাহাকে এই দুনিয়াতেও দেওয়া হয়। তাহার এই প্রার্থনাও মঞ্জুর করা হইল। আল্লাহর নির্দেশ আসিল, তিনি যেন আরও অর্ধ মঞ্জিল পথ পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন।
হযরত আদম (আ.) তাহাই করিলেন। আরও অর্ধ মঞ্জিল পথ পশ্চিম দিকে অগ্রসর হইয়া দেখিলেন, স্থানটি হালকা বন বেষ্টিত একটি উপত্যকা। আশেপাশে ছোট বড় কয়েকটি পাহাড় এবং অনুচ্চ টিলা রহিয়াছে।
আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিব্রাইল (আ.) আসিয়া এমন একটি স্থান চৌহদ্দী করিয়া দিলেন, সে স্থানটি হইল বেহেস্তের এবাদতগাহ্ বা মসজিদ বাইতুল মামুরের ঠিক নীচে।
হযরত জিব্রাইল (আ.) হযরত আদম (আ.)কে হাতে কলমে ঘর নির্মাণের কলাকৌশল শিখাইতে যত্নবান হইলেন। তিনিও আগ্রহের সহিত কাজ শিখিতে লাগিলেন। ফলে অল্প দিনেই নির্মাণ হইয়া গেল একটি ঘর।
ইহাই কাবা বা বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর। বনি আদম কর্তৃক আবাদ হইবার সূচনাতেই নির্মিত হইল এই ঘর। তাই পবিত্র কোরানে আল্লাহ ঘোষণা করিয়াছেন-
ইন্না আওয়ালা বাইতিঁও বুজিয়া লিন নাছে,
আল্লাযী বে বাক্কাতা মুবারাকাঁও ওয়া
হুদাল লিল আলামীন। ৩/৯৬
‘নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য যে ঘর প্রথম নির্মাণ করা হইয়াছে তাহা এই ঘর যাহা মক্কাতে অবস্থিত এবং সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক এবং বরকতময়।’ (৩/৯৬)
ইহাই হইল মানবজাতি কর্তৃক দুনিয়ার বুকে নির্মিত প্রথম ঘর, যাহা বসবাসের জন্য নয়, যাহা আল্লাহর এবাদত করিবার জন্য।
ইহার পর হযরত আদম (আ.) প্রার্থনা করিলেন যেন তাহাকে বাইতুল মামুরের একটি প্রস্তর খণ্ড দেওয়া হয়, যাহা তিনি কাবায় স্থাপন করিয়া কাবাকে বাইতুল মামুরের সমতুল্য বলিয়া মনে করিতে পারেন। তাহার এই প্রার্থনাও কবুল করা হ্ইল। বাইতুল মামুরের ভিত্তি স্থাপিত প্রস্তরগুলির একটি হযরত আদম (আ.)কে উপহার দেওয়া হইল। এই পবিত্র প্রস্তরখণ্ডটির নাম ছিল হাজরে আবওয়াজ বা সাদা প্রস্তর। হযরত আদম (আ.) এই পবিত্র প্রস্তরখণ্ডটি কাবাগৃহের এক কোণে স্থাপন করিলেন।
পরবর্তী সময়ে আল্লাহর নির্দেশ হইল এই খানায়ে কাবা তোয়াফ করিবার এবং হাজরে আবওয়াজ চুম্বন করিবার।
শুরু হইল বনি আদম কর্তৃক কাবা তোয়াফ আর প্রস্তুর চুম্বন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া চুম্বনে চুম্বনে বনি আদমদের গোনাহ শোধন করিতে করিতে এই সাদা বর্ণের প্রস্তরটি কালো বর্ণ ধারণ করিয়াছে। ফলে হাজরে আবওয়াজের নাম হইয়া গেল হাজরে আছওয়াদ বা কালো প্রস্তর। মহানবী (সা.) বলিয়াছেন-
‘নাজালা হাজরাল আছওয়াদু মিনাল জান্নাতে।
ওয়া হুয়া আশাদ্দু বায়াজান মিনাশ লাবানে।
ফা ছাওয়াদাতহু খাতায়া বনি আদম।
হাজরে আছওয়াদ বেহেস্তে হইতে অবতারণ করা হইয়া ছিল এবং উহা ছিল দুধের চাইতেও অধিক সাদা। বনি আদমের গোনায় তাহাকে কালো বর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে।
হযরত আদম (আ.) বাইতুল্লাহ নির্মাণ শেষ করিয়া তাহার অনতিদূরেই তাঁহার নিজের বসতবাটী নির্মাণ করিলেন। তিনি কাবায় নামাজ পড়েন, ঘর তোয়াফ করেন। তাহার সন্তানেরাও এই কাবাকে কেন্দ্র করিয়াই পরবর্তী সময়ে ঘরবাড়ী নির্মাণ করিতে থাকে।
এমনিভাবে খানায়ে কাবাকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়ে উঠিতে থাকে দুনিয়ার প্রথম জনপদ। আর এই কাবা কেন্দ্রীক তাকে কেন্দ্র করিয়াই উঠিয়ে লাগিল এই দুনিয়ার প্রথম জনপদ বা নগরী মক্কা।
ইহা স্বতসিদ্ধ সত্য কথা যে, যে ঘরকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠিল দুনিয়ার প্রথম জনপদ এবং নগরী সেখানে অবশ্যই সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিলই। আরব ভূ-খণ্ডে কোনো নদী-নালা এখনও যেমন নাই, তেমনি আগেও ছিল না। এখনের মত তখনও কালে ভদ্রে বৃষ্টি হইত বটে। কিন্তু তাহার দ্বারা তো আর সারা বৎসর চলিত না। এখনের মত তখনের আরববাসীও নির্ভর করিত কূপ এবং ঝরনার পানির উপরেই। এখনও যেমন আরবের যেখানে ওয়েশীম সেখানেই মরুদ্যান, সেখানেই জনপদ, তখনও ছিল তাহাই। পানিসুলভ অঞ্চলের আওলাদে আদমগণ বসতি স্থাপন করিয়াছিল।
মহান আল্লাহ যেখানে হযরত আদম (আ.)কে ঘর নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করিয়া দিয়াছিলেন, সেখানে সে পানির ব্যবস্থাও করিয়া দিয়াছিলেন বা বলিয়া দিয়াছিলেন কিংবা শিখাইয়া দিয়াছিলেন, কিভাবে জমীন হইতে পানি বাহির করিতে হইবে, তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।
কাবার ভিত্তি স্থাপন হইতে আরম্ভ করিয়া ঘর নির্মাণ কার্য্য শেষ করা পর্যন্ত যে পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন ছিল, তাহার মওজুদ বা ব্যবস্থা ছিল না, তাহা হইতেই পারে না। বরং আগে হইয়াছিল পানির ব্যবস্থা. তাহার পরে হইয়াছিল ঘর নির্মাণের আয়োজন।
ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই যে, হযরত আদম (আ.) যখন আল্লাহর নিকট হইতে বাইতুল মামুরের এক খণ্ড প্রস্তর চাহিয়া আনিয়া ছিলেন, তখন তিনি বেহেস্তের যে ঝরনার পানিতে অজু গোছল করিতেন, বরকতান সেই ঝরনার কিছু পানিও চাহিয়া আনিয়া ছিলেন। বেহেস্তের সেই ঝরনা হইতে প্রাপ্ত পানির পেয়ালাটির কিছু পানি তিনি বরকতান দাঁড়াইয়া পান করিলেন আর অবশিষ্ট পানিটুকু তিনি কাবার অনতিদূরে একটি গর্তে ঢালিয়া দিলেন। আল্লাহর কুদরতে সেই গর্তটিই একটি কূপে পরিণত হইল। ইহার পানিতেই তিনি অজু-গোসল করিতেন, পান করিতেন। পরবর্তী সময়ে ইহাই হইল বীরে জমজম বা জমজম কূপ।
এই পানির পবিত্রতা রক্ষার্থে তিনি তাহা ক্ষেতখামারে ব্যবহার করিতেন না। ক্ষেত-খামারে ব্যবহার করিতেন অন্যান্য কূপ বা ঝরনার পানি।
প্রথম প্রথম হযরত আদম (আ.) নিজেই খেত-খামারে মাটি কাটিতেন, চাষাবাদ করিতেন, পানি সেচ দিতেন। আর বিবি হাওয়া নিজ হাতে তাঁতে কাপড় বুনিতেন। তাই কবি বলিয়াছেন,
আদম যখন কাটত মাটি
হাওয়া যখন বুনত তাঁত!
তখন কোথায় ছিলে হে
ভদ্র লোকের জাত?
সময়ের প্রবাহে হযরত আদম (আ.)-এর ছেলেমেয়েদের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল। বাড়িতে লাগিল পোষ্য, সংসারের খরচ এবং শ্রম। কিন্তু এখন আর তিনি কাজ করেন না। যোগ্যতা অনুসারে তিনি ছেলেদের মধ্যে কাজ ভাগ করিয়া দিয়াছেন।
কেহ কর্মকার। তাহার সঙ্গে আছে আরও কয়েকজন ভাই সহকারী হিসাবে। তাহারা দা, কুড়াল, কাস্তে, খুন্তা, কোদাল ইত্যাদি তৈয়ার করিয়া সংসারের চাহিদা সব মিটায়। একদলে করে কুম্ভকারের কা। তাহারা সংসারের হাঁড়ি, পাতিল, থালা, বাসন জোগান দেয়। একদল রাজমিস্ত্রী এবং সূত্রধর। তাহারা প্রয়োজন মত ঘরবাড়ী এবং আসবাবপত্র তৈয়ার করিতেছে।
এমনিভাবে চর্মকারের দল, তন্তুকারের দল, কাস্তেকারের দল (চাষী) নিজ নিজ দায়িত্ব আনজাম দিয়া কাবা কেন্দ্রীক মক্কা গড়িয়া তুলিতেছে। একদলের উপর ন্যাস্ত হইয়াছে পশুপাল, তাহারা উট-দুম্বা, অশ^-মেষ লইয়া মরুদ্যান হইতে মরুদ্যানে ঘুরিয়া বেড়ায়।
মেয়েরাও বাড়ীর কাজ আনজাম দিয়া থাকে। হযরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া ছেলে মেয়েদের কাজের তদারকী করেন।
কালক্রমে হযরত আদম (আ.)-এর ২৩৯ জন ছেলে এবং অনুরূপ সংখ্যক মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাহারা জানে যে, তাহারাই দুনিয়ার প্রথম মানব গোষ্ঠী, আল্লাহর দুনিয়া তাহারাই প্রথম আবাদ করিতেছে। তাহাদের মক্কা ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন আবাদ বা জনপদ নাই। চন্দ্র সূর্যও সারাদিন সারারাত আল্লাহর দুনিয়া ছফর করে। দেখে তাহাদের ছাড়া আর কোন মানুষ দুনিয়াতে নাই। মক্কা ছাড়া আর জনপদ নাই। তাই তাহাদের আনন্দ আর ধরে না।
তাহাদের ভাইয়ে ভাইয়ে গলায় গলায় মিল। তাহারা এক সাথে চলে, এক সাথে খেলে। পরস্পরকে সাহায্য করিয়া নিজ নিজ কাজের আনজাম দেয়।
এক সাথে নামায পড়ে। এক সাথে কাবা তোয়াফ করে। রাত্রে মাতা পিতার চারিপাশে গোল হইয়া বসে। শুনে বেহেস্তের নাজ নেয়ামতের কথা, শুনে কত বেহেস্তী কাহিনী। শুনে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করিবার ভয়াবহ পরিণামের কথা চিনে নেয় শয়তানের স্বরূপ। এমনিভাবেই মাতাপিতাকে কেন্দ্র করিয়াই গড়িয়া উঠিয়াছিল ধর্মীয় এবং সামাজিক জীবন, তাহাদের পরস্পরের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি।
পশুপালের ভারপ্রান্তে ছেলেরা একদিন পশুপাল লইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে উপস্থিত হইল সাগর তীরে। ঘুরিয়ে ফিরিয়া দেখিল স্থানটি। একদিন তাহারা মক্কায় ফিরিয়া আসিয়া মায়ের কাছে বর্ণনা করিয়া স্থানটির।
সব শুনিয়া বিবি হাওয়া স্থানটি চিনিলেন এবং বলিলেন, ওখানেই আমি দুনিয়াতে প্রথম এসেছিলাম। স্থানটি যে ভাল, তাতে সন্দেহ নেই।
ছেলেরা পশুপাল নিয়া মায়ের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে আসা-যাওয়া করিতে লাড়িল এবং দুই এক দিন বিশ্রাম করিবার জন্য সেখঅনে তৈয়ার করিল একটি জিরাত বাড়ী। পশুপাল নিয়া এখানেই তাহারা দুই একদিন কাটায়, জিরায় এবং বিশ্রাম নেয়। আবার মক্কায় ফিরিয়া যায়।
পরবর্তী সময়ে হযরত আদম (আ.)-এর নাতীনগণ এই জিরাত বাড়ীকে কেন্দ্র করিয়া এখানেও গড়িয়া তুলিল আরও একটি জনপদ বা নগরী।
আরবীতে দাদী বা নানীকে বলা হয় ‘জাদ্দাহ’ দাদীর স্মৃতিকে স্মরণ রাখিবার জন্যই নাতীনগণ স্থানটির নামকরণ করিল ‘জাদ্দাহ’ এই ‘জাদ্দাহ’ হইতেই হইল জিদ্দাহ বা জিদ্দা।
এমনিভাবে তাহারা ঘুরিতে ঘুরিতে একদিন পৌঁছিল একটি মনোরম মরুদ্যানে। ভারী চমৎকার স্থান। কুলু কুলু ঝরনা কিচির মিচির পাখি ডাকা বনানী সবুজ শ্যামল বাগান। এমনটি বুঝি আর কোথাও নাই। বৃক্ষগুলিতে জন্মিয়া রহিয়াছে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিভিন্ন জাতের মেওয়া।
আওলাদে আদমগণ খুশিতে বাক! বাক!! আনন্দে আটখানা, আহলাদে উচ্ছ্বল। তাহারা অশ^, উষ্ট্রবোঝাই করিয়া ফল নিয়া আসিল মক্কায়। সেই মরুদ্যানের সৌন্দর্যের কথা শুনিয়া মাতাপিতার অনুমতিক্রমে অনেক আওলাদে আদম সেখানে যাইয়া প্রথমে জিরাত বাড়ী এবং কালক্রমে স্থায়ী ঘরবাড়ী নির্মাণ করিয়া ফেলিল।
সেখানে যাইবার সময় তাহারা কাবা তোয়াফ করিয়া যাইত কিংবা সেখান হইতে আসিয়াও কাবা তোয়াফ করিয়া থাকিত। এই জন্য তাহাদের বলা হইত ‘তায়েফুন’ বা তোয়াফকারী। পরবর্তী সময়ে এই তায়েফুনদের বাসস্থানটিই ‘তায়েফ’ বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইহাই হইল দুনিয়ার তৃতীয় জনপদ।
কাবা বা বাইতুল্লাহ তোয়াফ, মাতাপিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ, তাহাদের দোয়া ও উপদেশাবলী শ্রবণ, ভাইবোনদের সহিত সাক্ষাৎ এবং ভাব বিনিময় সৌহার্দ্য স্থাপন, পরিবারিক শৃঙ্খলা বিধান, মক্কায় তৈরী বিভিন্ন প্রকার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ, পশুপাল এবং উৎপন্ন শষ্যের সুষম বণ্টন ইত্যাদি প্রয়োজনে জিদ্দা এবং তায়েফে বসবাসকারী আওলাদে আদমগণ মক্কায় আসে; মক্কায় বসবাসকারী আওলাদগণও বিভিন্ন কারণে জিদ্দা তায়েফে আসা-যাওয়া করে।
হযরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়ার মনে তখন অনেক আনন্দ। তাঁহাদের আওলাদগণ আল্লাহর দুনিয়া আবাদ করিতেছে, এই আনন্দ; অনেক ছেলেমেয়ে হইয়াছে, ইহার খুশী, অনেক নাতী-নাতনী হইয়াছে এই গৌরব। একবার তায়েফ, একবার জিদ্দা ছেলে নাতিনদের বাড়ীতে বেড়াইতে যাওয়ার সখ।
এমনিভাবেই শুরু হইল মানব গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা। কাবাকেন্দ্রীক মক্কা এবং মক্কা কেন্দ্রীকতাকে কেন্দ্র করিয়া আরব তথা দুনিয়া আবাদ।
৪৭৮ জন ছেলে মেয়ে, নাতী-নাতনী ইত্যাদি মিলাইয়া আওলাদে আদমের সংখ্যা এখন বেশুমার। ইহাদের জীবনযাত্রা কোন বিধানে চলিবে, কেমনে গ্রন্থিত হইবে তাহাদের দাম্পত্য জীবন, কিভাবে করিবে আল্লাহর এবাদত বন্দেগী, ইত্যাদি নিত্য আবশ্যিক কারণে আল্লাহ মেহেরবান হযরত আদম (আ.)কে দান করিলেন নবূয়ত এবং তাহাতে দিলেন একটি শরীয়ত বিধানও। তিনি বাণী দিলেন,
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আদামু ছাফীহুল্লাহ,
শরীয়তের একটি বিধানে বলা হইল সহোদর ভাই বোনে বিবাহ হারাম। আল্লাহর অনুগ্রহে বিবি হাওয়ার প্রতিবারে একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে জমজ জন্ম হইত। বিধানমতে এই দুইজন হইল সহোদর। ইহাদের দুইজনের বিবাহ হারাম।
আগের বৎসরের জমজের ছেলে, পরের বৎসরের জমজের মেয়ে এবং আগের বৎসরের জমজের মেয়ে, পরের বৎসরের জমজের ছেলের সাথে বিবাহ হইবে, ইহাই হইল শরীয়তের বিধান। তখনকার যুগে, মানব গোষ্ঠী বিস্তারের প্রাথমিক যুগে, ইহারা সহোদর ছিল না। শরীয়তের এই বিধানই ছিল। এই বিধান মতই হযরত (আ.) ছেলে মেয়েদের বিবাহ দিয়া আসিতেছেন।
বিবাহের পর নিজ নিজ স্ত্রীদের লইয়া কেহ জিদ্দায় চলিয়া যায়, কেহ বা যায় তায়েফে, আর কেহ বা মাতাপিতার অনুমতিক্রমে মক্কাতেই থাকিয়া যায়। পিতার দেওয়া বিধান অনুযায়া চলে তাহাদের দাম্পত্য জীবন, ধর্মীয় জীবন এবং সমাজ জীবন।


লা আকতুলান্নাকা ৫ : ২৭
আল্লাহর নামে দেয় কোরবানী
হাবীল কাবীল দুইটি ভাই!
হাবীলের কোরবানী যাহা
করেন কবুল আল্লাহ সাই!!
লাজে গোসসায় কয় কাবীল
ওরে ও ভাই শুন হাবীল!!
আমি তোকে করব খুন
কয় কাবীল মোমেনের কোরবান
করেন কবুল হু রাব্বুল!!
আমার উপর হাত তুলিলেও
তুলব না মুই শুনরে ভাই!!
গফুর আল্লাহ মেহেরময়
অন্তরে মোর তাহার ভয়!!
হইল কথা এই আমার …
লইবে তুমি তোমার মাথায়
পাপের বোঝা দুই জনার
হইবে তুমি নরকবাসী
জালেমদিগের বদলা তাই!! ঐ
হযরত আদম (আ.)-এর এতজন ছেলেমেয়ের মধ্যে কোরান হাদীসে ছেলেদের মধ্যে বিশেষভাবে হযরত শীশ (আ.) হাবীল, কাবীল এবং মেয়েদের মধ্যে লুবাদা ও আকলীমার নাম পাওয়া যায়। হযরত শীশ (আ.)-এর নাম নবী হিসাবে এবং হাবীল কাবীলের নাম ও লুবাদা, আকলীমার নাম বিশেষ একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে।
হাবীলের সহোদর বোন লুবাদা এবং পরবর্তী জমজ কাবীলের সহোদর বোন আকলীমা। ইহাদের জন্মের পর হইতেই শরীয়ত অনুযায়ী সাব্যস্ত হইয়া রহিয়াছে যে, হাবীলের সঙ্গে আকলীমার এবং কাবীলের সঙ্গে লুবাদার বিবাহ হইবে।
বয়োবৃদ্ধিল সঙ্গে সঙ্গেই ইহাদের মনের কল্পনার কিশলয়গুলি মানবমনের সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারেই নিজ নিজ নির্ধারিত জনকে কেন্দ্র করিয়াই বাড়িতে থাকে। আকলীমার কল্পনার রাজ্য হাবীলকে কেন্দ্র প্রসারিত হয়। সেই রাজ্যে হাবীল সম্রাট, আর সে সম্রাজ্ঞী। লুবাদার মনের স্বচ্ছ নীলাকাশটিতে কাবীল আলোর সম্রাট একমাত্র দিনমনি।
হাবীল ধর্মভীরু, আল্লাহভক্ত, মাতৃপাগল, পিতৃগতপ্রাণ, ভ্রাতৃপ্রতীম ব্যক্তি, ভগ্নি-সুহৃদজন বলিয়া পরিচিত। মাতাপিতাকে অত্যাধিক ভালবাসে বলিয়াই মাতাপিতাও তাহাকে খুব স্নেহ করেন। ছোট ভাই বোনেরা শ্রদ্ধা করে। বড় ভাই বোনেরা ভালবাসে। সে নম্র, মিষ্টভাষী, শান্তশিষ্ট এবং ভদ্র বলিয়া খ্যাত। তাহার উপর ন্যস্ত হইয়াছে পশুপালনের ভার। সে তাহার পশুপাল লইয়া মরুদ্যান হইতে মরুদ্যানে ঘুরিয়া বেড়ায়। বৎসরের কোনা কোন সময় পশুপালসহ জিদ্দার জিরাত বাড়িতে দুই এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেয়। কোন কোন সময় বা তায়েফের জিয়াত বাড়ীতেও দুই এক সপ্তাহ কাটায়। বৎসরে তিন চারবার মক্কায় আসিয়া কাবা জিয়ারত এবং মাতাপিতার চরণদর্শন করে।
কাবীল কিছুটা উগ্র, বেয়াদব, বদমেজাজী এবং উচ্ছৃঙ্খল। তাহার আচরণের জন্য কেহই তাহাকে পছন্দ করে না। তাহার উপর ন্যস্ত হইয়াছে কৃষিকাজের ভার। তায়েফের উর্বর ভূমিতে তাহার খামার। কাজের চাপের জন্য সে তাহার সহকর্মী ভাইদের লইয়া স্থায়ীভাবে তায়েফেই থাকে।
বিবি হাওয়া বৎসরে দুই একবার করিয়া তায়েফ এবং জিদ্দায় যান। কিছুদিন করিয়া থাকেনও। সেই পালা অনুযায়ী বিবি হাওয়া আজ তায়েফ পৌঁছিয়াছেন। অন্যান্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে লুবাদা এবং আকলীমাকেও আজ তিনি সঙ্গে আনিয়াছেন।
এই ছফরের পিছনে বিবি হাওয়ার একটি উদ্দেশ্যও আছে। কাবীল তো তায়েফে আছেই, হাবীলও এখন পশুপাল লইয়া তায়েফের উপকণ্ঠে একটি চারণভূমিতে অবস্থান করিতেছে। তাহাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করিয়া আগামী ৯ই জিলহজ তাহাদের বিবাহ সম্পন্ন করিয়া দিবেন। যেহেতু পূর্ববর্তী সমস্ত ছেলেমেয়েদের বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। কাজেই এখন হাবীল কাবীল এবং লুবাদা আকলীমার পালা।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে খামার হইতে ফিরিয়া আসিল কাবীল, পশুপাল লইয়া চারণভূমি হইতে ফিরিয়া আসল হাবীলও। তাহারা মাকে দেখিয়া খুব খুশী হইল, খুশী হইল আকলীমা এবং লুবাদাকে দেখিয়াও। বাকদত্তা স্ত্রীকে দেখিয়া কে খুশী না হয়?
রাত্রে আহারাদি সারিয়া বিবি হাওয়া হাবীল, কাবীল এবং আকলীমা লুবাদাকে লইয়া বসিলেন। তাহার ডান দিকে হাবীল কাবীল এবং বামদিকে লুবাদা আকলীমা। তাহারা লাজে নতমুখী। নেকাবে ঢাকা। অন্যান্য ছেলেমেয়েরা একদিকে ঠাঁই লইয়াছে।
তিনি প্রথমে হামদে বারী তালা এবং বেহেস্তের শোভা এবং অপরিসীম নেয়ামতের বর্ণনা করিয়া বলিতে লাগিলেন, হে আমার প্রাণাধিক পুত্রকন্যাগণ! মহান আল্লাহ অনুগ্রহ করে তোমাদের আব্বি এবং আমাকে মাতাপিতা ছাড়াই তাঁর নিজ কুদরতে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা বহু দিন শুনেছ যে, তাঁর একটি নির্দেশ অমান্য করার কারণে তিনি আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তোমরা আমাদের ঔরশজাত, গর্ভজাত সন্তান। তোমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছি, খবরদার! হুঁশিয়ার!! কোন অবস্থাতেই মহান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা যাবে না। তাহলে তোমাদের উপরেও নেমে আসবে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। আর বিশেষভঅবে মনে রাখবে, ইবলিশ আল্লাহর আদেশ না মেনে; অহংকারে অবাধ্যতা করায় সে হয়ে গেল অভিশম্পাদিত মালাউন, শয়তান। শয়তান তোমাদের চির দুশমন।
যাহা হউক। সেই মহান আল্লাহর নির্দেশানুসারেই, শরীয়তের বিধান মতেই আমরা তোমাদের অগ্রজদের বিবাহ শাদী দিয়ে আসছি। সেমতে আগামী ৯ই জিলহজ কাবীল ও লুবাদা এবং হাবীল ও আকলীমার শুভ বিবাহ সম্পন্ন করব। সেদিন তায়েফে এবং জিদ্দায় বসবাসকারী আমাদের সকল ছেলেমেয়ে, নাতী-নাতনী মক্কায় সমবেত হবে। হাবীল-কাবীল! তোমরাও তার আগেই মক্কায় চলে যেও। আমি দু-একদিনের মধ্যেই লুবাদা, আকলীমাকে নিয়ে মক্কায় চলে যাব। তবে শরীয়তের বিধানমতে (কানুনে আদম) এখনি আমার সম্মুখে হাবীল আকলীমাকে এবং কাবীল লুবাদাকে কনে দর্শন করে দোয়া কর।
প্রথামত বিবি হাওয়া অগ্রজ হিসাবে হাবীলকে বলিয়েন, তুমি এগিয়ে এসে আকলীমার সুখদর্শন কর এবং দোয়া করে যাও। — এই বলিয়া তিনি যেই উঠিয়া গিয়া আকলীমার নেকাবখানি টানিয়া ধরিলেন মাত্র, অমনি কাবীল এক লাফে উঠিয়া গিয়ে মায়ের হাত টান মারিয়া সরাইয়া দিয়া বলিল, অসম্ভব! হাবীল-আকলীমার বিয়ে হতে পারে না। আকলীমাকে বিয়ে করব আমি। কক্ষে বজ্রপাত হইল।
সহোদর ভাইয়ের মুখে এই কথা শুনিয়া লজ্জায়, ঘৃণায় অপমানে যেন মাটিতে মিশিয়া গেল আকলীমা। চোখে দেখিতে লাগল অন্ধকার সরিয়া গেল যেন তাহার পায়ের নীচের মাটি। ঘুরিতে লাগিল ঘর-দোর এবং মস্তক। সে টাল খাইয়া পড়িয়া গেল।
আকলীমার মুখ দর্শন করিবার জন্য হাবল সেই যে উঠিয়া দাঁড়াইয়া আকলীমার কাছে যাইবার মানসে পা বাড়াইয়া ছিল, সেই অবস্থাতেই স্থানুর মত সে ঠায় দাঁড়াইয়া রহিল। সে ভাবিতে লাগিল, আমি কি ভুল শুনিলাম? এমন বেশরা কথাও কাবীল বলিতে পারে? সে ভুরিয়া গেল নিজের অবস্থান।
লুবাদা কাঠের পুতুল। আজীবন যাহার ধ্যান করিয়াছি, যাহাকে ছাড়া আমার আর জীবন সঙ্গী নাই, তাহার মুখে এ কি অধর্মের কথা! ছিঃ! এমন কথাও মানুষ বলে?
কাবীলের হাতের ধাক্কা খাইয়া, তাহার মুখে অশ্লীল উক্তি শুনিয়া বিবি হাওয়া লাজে ঘৃণায় ক্ষোভে হযরত আদম (আ.)কে লক্ষ্য করিয়া সেই যে চিৎকার দিয়া ডাকিলেন, ওগো! শুনে যাও। তোমার কুপুত্র বলে কী? বলিয়ে যে টাল খাইয়া পড়িলেন, আর চাহিলেন না।
কাবীলের কথা শুনিয়া অন্যান্য ছেলেমেয়েরা যেমনি হইল মর্মাহত, তেমনি হইল ক্ষুব্ধ। কিন্তু তাহাকে বলিবে কী? সংজ্ঞাহীন মা এবং আকলীমাকে লইয়া তাহারা ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
কিছুক্ষণ চেষ্টা তদবির বরিবার ফলে তাহাদের জ্ঞান ফিরিয়া আসিল। জ্ঞান ফিরিয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গেই আকলীমা লুবাদা কক্ষ ত্যাগ করিল। কারণ কাবীল তখনও সেখানেই দাঁড়াইয়া।
বিবি হাওয়া কাবীলকে লক্ষ্য করিয়া বিললেন, তোমার অসঙ্গত উক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং লুবাদাকে কনে দর্শন করে দোয়া কর।
কাবীল বলিল, আমি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করব না এবং লুবাদাকে কনে দর্শনও করব না। কারণ লুবাদা কুশ্রী। আমি আকলীমাকেই বিয়ে করব। সে সুন্দরী। আমার সুন্দরী বোন আকলীমাকে হাবীল তার অঙ্কশায়িনী করবে? তা কখনও হতে দেব না। আমার জীবন থাকতে না।
বিবি হাওয়া বলিলেন, কিন্তু শরীয়তের বিধান তুমি অস্বীকার করতে পার না।
কাবীল গর্জিয়া উঠিল, মানি না আমি শরীয়ত, মানি না আমি বিধান। আমি আকলীমাকে বিয়ে করবই। জোর করেই করব। এই বলিয়া কাবীল ঝড়োবেগে কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেল।
কাবীল যে বিষ বাষ্প ছড়াইয়া দিল, তাহার প্রতিক্রিয়ায় রাত্রে কাহারো সুনিদ্রা হইল না। কাবীলের এহেন গর্হিত আচরণের জন্য বিবি হাওয়া সারা রাত কাঁদিয়া কাটাইলেন। আওলাদে আদমের দুনিয়া আবাদের সূচনাতেই সে যে বিদ্রোহের বীজ রোপন করিল, কেয়ামত পর্যন্ত তাহা যে কি রূপ বিরাট আকৃতি ধারণ করিবে, তাহা বিবি হাওয়ার কল্পনায় আসিল না।
হাবীল, আকলীমা, লুবাদা। নিজ নিজ প্রিয়জনকে নিয়া আবাল্যের কল্পনার স্বপ্নটি এইভাবে ধুলিস্যাত হইতে চলিয়াছে দেখিয়া তাহাদের কাহারো সুনিদ্রা হইল না। কি হইল, কি হইবে ইত্যাদি ভাবিতে ভাবিতেই সকাল হইয়া গেল।
কাবীল ভাবিতেছে, আকলীমা যেহেতু হাতের মুঠায় আসিয়া পড়িয়াছে, আর তাহাকে ছাড়া যায় না। মাকে শক্ত করিয়া ধরিয়া কালকেই বিবাহটা সারিয়া ফেলিতে হইবে। বলা যায় না, কখন আবার হাবীল বাঁধ সাধিয়া বসে। সকালে খামার-বাগানটা একনজর দেখিয়া আসিয়াই কাজ শেষ করিব।
অতি প্রত্যুষেই কাবীল খামারে চলিয়ে গেল। দেখে কি! রাত্রে বন্য পশুরা খামার এবং বাগানের অনেক ক্ষতি করিয়াছে। সে লাগিয়া গেল সেই গুলি সারিতে।
প্রাত্যাহিক অভ্যাসমত হাবীল সকালেই পশুপাল লইয়া চারণভূমিতে চলিয়া গেল। ভাবিল, পশুগুলি মাঠে ছাড়িয়া দিয়া আসিয়া শুনিব, আম্মি কী ফয়সালা করিবেন।
বিবি হাওয়া সকালে উঠিয়াই ভাবিলেন, না আর নয়! কাবীলের পাপপুরীতে আর নয়। লুবাদা আকলীমাকে লইয়া তিনি তৎক্ষণাৎ মক্কায় চলিয়া গেলেন। বিবি হাওয়ার কাছে তায়েফের খবর শুনিয়া হযরত আদম (আ.) হায়! হায়!! করিয়া উঠিলেন। বলিলেন, ইবলীশ শেষ পর্যন্ত কাবলীকে তার দলে টেনে নিয়েছে? সে যে আর কি সর্বনাশ করে বলে কে জানে?
তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁহার অন্য এক ছেলে সুরহাবীলকে তায়েফ পাঠাইয়া দিলেন যেন হাবীলকে মক্কায় ডাকিয়া লইয়া আসে।
এদিকে খামার হইতে কাবীল এবং চারণভূমি হইতে হাবীল যখন ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, বিবি হাওয়া লুবাদা আকলীমাকে লইয়া মক্কায় চলিয়া গিয়াছেন, তখন হাবীল মনে মনে খুশী হইল; কিন্তু কাবীল ভীষণভাবে ক্ষেপিয়া গিয়া ইহার জন্য হাবীলকেই দায়ী করিল। বলিল, তুমিই আকলীমাকে আম্মির সাথে ভাগিয়ে দিয়েছ।
হাবীল বলিল, আমি ভাগিয়ে দেইনি, বরং আম্মিই মনে হয় আকলীমা লুবাদাকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন।
কাবীল রাগিয়া বলিল, মরুভূমিতে শুকয়ে মরুক সে লুবাদা, তাতে আমার কি! তুমি আকলীমাকে ভাগিয়েছ কেন? তাই বল।
হাবীল নম্র হইয়া বলিল, বললাম তো ভাই, আমি তাকে ভাগাইনি। চারণভূমি হতে এসে দেখি তারা নেই। তাছাড়া তোমার প্রস্তাবটাও তো বে-শরীয়তী।
কাবীল প্রতিবাদ করিয়া বলিল, না। বেশরীয়তী নয়। আমার বোন আমি বিয়ে করব, এটাই শরীয়ত।
হাবীল বলিল, আমার কথা হল, তোমার প্রস্তাব বে-শরীয়তী এবং আমি আকলীমাকে ভাগাইনি। আর তোমার কথা হল, তোমার প্রস্তাব বে-শরীয়তী নয়, আর আমি আকলীমাকে ভাগিয়েছি, তাই না?
কাবীল বলিল, হ্যাঁ, ভাই।
হাবীল বলিল, কার কথা সত্য এবং কে সত্যের উপর আছে, আর কে মিথ্যার উপর আছে, এর ফায়ছালার জন্য চল আমরা কোরবানী অবশ্যই কবুল হবে। আর যে মিথ্যার উপর আছে, তার কোরবানী অবশ্যই কবুল হবে না।
ইহাতে কাবীল রাজী হইল। সে কতগুলি গমের শীষ অঁঅটি পাহাড়ের উপর রাখিল। হাবীলও একটি মোটা তাজা দুম্বা জবেহ করিয়া কাবীলের গমের আটির কাছে রাখিয়া দিয়া দুইজনই একটু দূরে বসিয়া রহিল দেখিবে কাহার কোরবানী কবুল হয়।
তখনকার দিনে নিয়ম ছিল, যাহার কোরবানী কবুল হইবে, আল্লাহর মেহেরবাণীতে একটি গায়েবী আগুন আসিয়া তাহার কোরবানীটি পুড়িয়া ভষ্ম করিয়া ফেলিবে। দেখা গেল, এক ঝলক গায়েবী আগুন আসিয়া এক হালকায় হাবীলের কোরবানীটি পুড়াইয়া ভষ্ম করিয়া চলিয়া গিয়াছে। কাবীলের কোরবানী তেমনিভাবেই পড়িয়া রহিল, একটি দানাও পুড়ায় নাই সেই গায়েবী আগুনে।
তাহার কোরবানী কবুল হইল না, এই লাজে শরমে গোসসায় কাবীল হাবীলকে বলিল,
‘লা আকতুলান্নাকা; আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব।
কাবীলের কথা শুনিয়া হাবীল বলিল, আল্লাহ মেহেরবান মোমেনের কোরবানী কবুল করে থাকেন। তবে জেনে রাখ, তুমি আমার উপর হাত তুললেও আমি তোমার উপর হাত তুলব না। কারণ আমার অন্তরে আল্লাহর ভয় বিরাজমান। তুমি আমাকে হত্যা করে আমার এবং তোমার দুইজনের পাপের ভার মাথায় নিবে। পরিণামে হবে দোজখবাসী। যারা জালেম তাদের বদলা এমনি হয়ে থাকে।
কিন্তু কাবীল হাবীলের ধর্মোপদেশ কানে নিল না। সে হাবীলকে গলা টিপিয়া হত্যা করিয়া ফেলিল।
ইহাই ছিল দুনিয়ার প্রথম মৃত্যু। কাজেই একজন মরিলে কেমন হয়, মৃত ব্যক্তিকে কী করিতে হয়, কাবীল তাহার কিছুই জানিত নয়। শুধু জানিত ‘হত্যা’ এই শব্দটি। আর বাস্তব হত্যা দেখিয়াছে উট-দুম্বা জবাই। তাও তো সেই গুলি হত্যার পর হাত-পা ছুড়াছুড়ি করে গেঁ গেঁ শব্দ করে।
কিন্তু হাবীল তো হাত-পা ছুড়াছুড়ি করিল না, গোঁ গোঁ শব্দও কলি না কেবল নেতাইয়া পড়িল। তাহাকে তো আমি জবাইও করিলাম না। কাজেই হাবীল মরে নাই, ঘুমাইয়া পড়িয়াছে মাত্র। সে কতক্ষণ হাবীলকে ঠেলা ধাক্কা দিল, ডাকিল, উঠ! উঠ!! কিন্তু হাবীল তো উঠিলই না। বরং কেমন বড় বড় চোখে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিয়াছে। তাহার যেন কেমন ভয় ভয় হইল। সে হাবীলের শব এখানেই ফেলিয়া বাড়ীতে ফিরিয়া গেল।
সুরহাবিল যথাসময়ে তায়েফ আসিয়া হাবীলকে বাড়িতে না পাইয়া ভাবিল, সে হয়ত চারণভূমিতেই আছে; এবং নিশ্চয়ই রাত্রে বাড়ীতে ফিরিয়ে আসিবে। কিন্তু রাত্রে বাড়ীতে ফিরিয়া আসিল কাবীল একা। সুরহাবিল কাবীলকেই জিজ্ঞাসা করিল, হাবীল ভাই কোথায়? তাকে যে আব্বা মক্কা ফিরে যেতে বলেছেন।
কাবীল কেমন যেন থতমত খাইয়া গেল। সহসা কিছু বলিতে পারিল না। হাবীল কি মরিয়া গিয়াছে, নাকি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, তাহার দিকে এমন বড় বড় করিয়া চাহিয়া রহিল কেন? এই সব আতংকেই কাবীল ছিল অস্বস্থিকর অবস্থায়; ভয়ে ভয়ে আসিয়াছে বাড়ীতে তদুপরি সুরহাবিলের জিজ্ঞাসা।
কি কাবীল ভাই! কথা বলছেন না কেন? সুরহাবিল আবার তাড়া ছিল।
কাবীল বলিল, হাবীল? মানে সে — এই — মানে এখানে নেই। সে মক্কায় চলে গেছে।
সুরহাবিলের প্রশ্নের জবাবে অন্যান্য ভাইয়েরা বলিল, হাবীল সে-ই যে সকালে পশুপাল নিয়ে মাঠে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি।
পরদিন সকলেই সুরহাবিল মক্কায় ফিরিয়া গিয়া তায়েফের সব খবর হযরত আদম (আ.)কে জানাইল। তিনি খবর শুনিয়া হাবীলের অমঙ্গল আশংকায় অস্থির হইয়া উঠিলেন। এরি মধ্যে তাহার কাছে অহি আসিয়া গেল যে, কাবীল হাবীলকে হত্যা করিয়া ফেলিয়াছে।
মক্কাময় কান্নার রোল পড়িয়া গেল। এমন ভাইটিকে কাবীল মারিয়া ফেলিল? ভাইবোনেরা কাঁদে, লুবাদা আকলীমা কাঁদে। বিবি হাওয়া কাঁদেন, আদম কাঁদেন।
কিছু প্রকৃতস্থ হইয়া আদম (আ.) তাহার অন্যান্য ছেলেদের হুকুম করিলেন, যাও! হাবীলের লাশসহ কাবীলকে ধরে নিয়ে এস। বিচার করতে হবে কাবীলের আর হাবীলের লাশ দাফন হবে মক্কায়। ভাইয়েরা ছুটিল।
তাহারা তায়েফ পৌঁছিয়া অন্যান্য ভাইদের কাছে শুনিল, কাবীল কয়েকদিন যাবতই বাড়ীতে আসে না। খামারেও নাই, চারণভূমিতেও নাই। হাবীলের মৃত্যুখবর শুনিয়া তায়েফবাসী ভাইয়েরাও মর্মাহত হইল এবং তাহারাও পিতৃ আজ্ঞা পালনে বাহির হইয়া পড়িল কাবীলকে ধরিতে, হাবীলের লাশ উদ্ধার করিতে।
তায়েফ, মক্কা, জিদ্দাময় এক ছুটাছুটি পড়িয়া গেল খুজ! খুজ!! খুজ!!! কিন্তু কোথায় কাবীল, কোথায় হাবীলের লাশ। পাহাড়ের উপর পাওয়া গেল শুধু ভষ্মীভূত দুম্বার আর আঁটিবাধা গমের শীষ। খবর শুনিয়া হযরত আদম (আ.) সকলকে বুঝাইয়া দিলেন, ইহার রহস্য কী? তিনি অহি মারফত এই ঘটনা জানিয়া ফেলিয়া ছিলেন। কাবীলের সন্ধান চলিতে থাকিল।
আর কাবীল! প্রতিদিন একবার করিয়া খামার হইতে হাবীলের লাশের কাছে ছুটিয়া যায়। দেখে তেমনি পড়িয়া রহিয়াছে। তেমনি তাহার দিকে চাহিয়া রহিয়াছে হাবীল। পঞ্চম দিন যখন সে লাশের কাছে গেল, তখন গায়েবী আওয়াজ হইল, ভয় কর! ভয় কর!!
আওয়াজ শুনিয়া কাবীল ভীষণ ভয় পাইল। চহিয়া দেখে আশেপাশে কেহ নাই। তাহার ভয় আরও বেশী হইল। সে ডাইনে-বামে, অগ্রে-পশ্চাৎ চাহিয়া চাহিয়া দেখে, কে কথা বলে। আবার আওয়াজ হইল, ভয় কর!
ভয়ে কাবীলের শরীর কাটা দিয়া উঠিল। সে দিশা কূল না পাইয়া হাবীলের লাশ কাঁধে লইয়া দৌড়াইতে লাগিল। দৌড়াইল সারাদিন। রাত্রে একটি পাহাড়ের গর্তে লাশ নামাইয়া বসিয়া রহিল।
সকালে আবার আওয়াজ হইল, ভয় কর। কাবীল লাশ কাঁধে লইয়া আবার ছুটিল। সারাদিন লাশ কাঁধে ঘুরিয়া বেড়াইল। রাত্রে আবার পূর্ববৎ বিশ্রাম … এমনিভাবে কাবীলের দিমে বিপদ হইল। লাশ কাঁধ হইতে নামাইতে পারে না। নামাইতে গেলেই তাহা চুম্বকের মত তাহার কাঁধে আসিয়া থাকে। লাশ কাঁধে নিয়াই গাছের ফল ঝরনার পানি পান করিতে হয়। রাত্রি হইলেই চুম্বক আর থাকে না। কাধ হইতে লাশ নামাইতে পারে। কিন্তু বিপদ হয়, তখন সে আর চোখে দেখে না, যেন রাতকানা। হাত পা-ও ফেলিতে পারে না। আড়ষ্ট হইয়া থাকে। পাপে কাল হইয়া গেল কাবীল।
সাকল হইলেই চোখেও দেখে, হাত পায়ের আড়ষ্টতাও আর থাকে না এবং আওয়াজও হয়, ভয় কর। কাবীল অমনি লাশ কাঁধে লইয়া আবার ছুটে।
এমনিভাবে একদিন নয়, দুইদিন নয়, এক সপ্তাহ নয়, দুই সপ্তাহ নয়, এক মাস নয়, দুই মাস নয়। পুরা একটি বৎসর কাবীল হাবীলের লাশ কাঁধে লইয়া বনে-জংগলে, পাহাড়ে-পর্বতে, মাঠে-ময়দানে ঘুরিয়া বেড়াইল। কিন্তু কোন দিন সন্ধানী ভাইদের সাথে তার দেখা হইল না। ধরাও পড়িল না।
একদিন কাবীল লাশ কাঁধে লইয়াই একটি গাছের ছায়ায় বসিয়া বিশ্রাম করিতে ছিল। হঠাৎ দেখে কি! দুইটি কাক ঝগড়া শুরু করিয়াছে এবং এক সময় একটি কাক অপরটিকে মারিয়া ফেলিল। তারপর জীবিত কাকটি ঠুকরাইয়া খামছাইয়া মাটিতে একটি গর্ত করিয়া মৃত কাকটিকে সেই গর্তে ফেলিয়া মাটি চাপা দিল। ইহা দেখিয়া কাবীল বলিল,
ইয়া ওয়ায়লাতা, আ আজছতু আন আকুনা মিছলা হাজাল গুরাব।’ ৫ : ৩১
শয়তান দাগায় ভ্রান্ত কাবীল
ঘটাইল রে কোনো প্রমাদ!
হইল শুরু আদম কূলে
খুন-খারাবী রক্তপাত!!
রিপুর শিকার হয় কাবীল!
করল কাতল ভাই হাবীল!!
হইল ক্ষতি তার আখের
ভাই মারিয়া রয় বিপাকে
করবে কি বা লাশ ভাইয়ের!!
হুর হুকুমে একটি যুগল
কাক আসিল তাই হঠাৎ!! ঐ
ঝগড়াঝাটি করিল খন,
একটি কাকের হয় মরণ।
জমিন খোড়ে ঢাকল লাশ,
তাই দেখিয়া আফসোস করল কাবীল
হায়রে আফসোস সর্বনাশ!!
একটি কাকের বুদ্ধি নাই মোর,
ভাই দাফন দেয় তৎক্ষণাৎ!! ঐ
কাকের কবর দেখিয়া কাবীল ভাবিল, হায়! একটি কাকের বুদ্ধিও আমার মাথায় নাই। আমি এ দীর্ঘ লাশ কাঁধে লইয়া অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। অতঃপর সে বড় একটি একটি গর্ত খুড়িতে শুরু করিল।
গর্ত খোঁড়ার পর কারীমের কাঁধ হইতে লাশের চুম্বক ছাড়িয়া দিল। সে লাশ দাফন করিয়া পাইল রেহাই।
মাশরেকাইন হইতে মাগরেবান, জুনুব হইতে শিমাল পর্যন্ত যত মানুষ হযরত আদম (আ.) হইতে আরম্ভ করিয়া আজকে পর্যন্ত এবং কেয়ামত পর্যন্ত নাহকভাবে খুন বা নিহত হইয়াছে বা হইবে। সেই নিহত ব্যক্তির সমস্ত পাপ (যদি থাকিয়া থাকে) এবং ঘাতকের সমস্ত পাপের সমান সংখ্যক পাপ কাবীলের নামে লেখা হইতেছে এবং লেখা হইবে।
কাবীল তায়েফের উদ্দেশ্যে ছুটিল। এই এক বৎসরে তাহার আকলীমার কি জানি হইল, সে হাবীলকে মারিয়া ফেলিয়াছে ইহা কেহ জানিতে পারিয়াছে কি না, জানিতে থাকিলে তাহার কী হইবে ইত্যাদি ভাবিতে ভাবিতে সে চলিয়াছে। এই এক বৎসর যাবৎ সে কোন মানুষ দেখে নাই। হঠাৎ দেখে কি! একটি গাছের ছায়ায় তাহাদেরই এক অন্ধ ভাই আমাইশ বসিয়া রহিয়াছে। সে ছুটিয়া গিয়া আমাইশের কাছে বসিয়া পড়িল এবং তুমি এখানে কার সঙ্গে কিভাবে এলে ভাই আমাইশ বলিয়া তাহাকে লুফিয়া নিল।
আমাইশ বলিল, আমি অন্যান্য ভাইদের সাথে এসেছি। তারা আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে তোমাকে খুঁজতে গেছে। আজ এক বৎসর যাবৎ আমরা তোমাকে এবং হাবীলের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছি।
কাবীল সাংঘাতিকভাবে চমকিয়া উঠিয়া বলিল, কি বললে হাবীলের লাশ!
আমাইশ বলিল, হ্যাঁ। তুমি যে হাবীলকে মেরে ফেলেছ, সেট আব্বা জানতে পেরেছেন। তাই তার লাশসহ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য আব্বার নির্দেশ। মক্কায় নিয়ে যাবার পর হবে তোমার বিচার।
ততক্ষণে আমাইশ কাবীলের কব্জিতে শক্ত করিয়া ধরিয়া ফেলিয়াছে। কাবীল বুঝিল, তাহাকে বন্দী করা হইল। সে ধস্তাধস্তি করিতে লাগিল মুক্তি পাইবার জন্য। কিন্তু কাবীল জানে না যে, আমাইশ তাহার চাইতেও অধিক শক্তিশালী। মরিয়া হইয়া লাগিয়াছে দুই জনই। এক পর্যায়ে কাবীল আমাইশকে পদাঘাত করিতে লাগিল। আমাইশ জানে কাবীল ছাড়া পাইলে আর তাহাকে ধরা যাইবে না। কাজেই সে লাথি খাইয়াও কাবীলের হাত ছাড়িতেছে না বরং কাবীলের দুইটি পা-ই জড়াইয়া ধরিল। কাবীল পড়িয়া গোল এবং আমাইশকে নীচে ফেলিয়া তাহার বুকে উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। আমাইশেরও সেই চেষ্টা। এক সময় আমাইশই উঠিয়া বসিল কাবিলের বুকে এবং চাপিয়া ধরিল তাহার গলায়। কাবীলের মনে হইল তাহার বুকে পর্বত চাপিয়া ধরিয়াছে।
কিছুক্ষণ পর ফিরিয়া আসিল আমাইশের অন্যান্য ভাইয়েরা। ভাইদের সাড়া পাইয়া আমাইশ ডাকিয়া বলিতে লাগিল, বন্দী করেছি! বন্ধী করেছি কাবীলকে। তোমরা একে বেঁধে ফেল।
সবাই ছুটিয়া আসিয়া আমাইশকে সরাইয়া কাবীলকে ধরিয়া দেখিল, কাবলী ঠাণ্ডা-হীম।
খবর পাইয়া হযরত আদম (আ.) নির্দেশ পাঠাইলেন কাবীলকে সেখানেই দাফন করিতে। কিন্তু হাবীলের কবরের আর কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।
হযরত আদম (আ.) দুনিয়াতে আসার পর এক হাজার বৎসর জীবিত ছিলেন। তাহার জীবদ্দশাতেই মক্কা জিদ্দা এবং তায়েফ ছাড়াও মদীনা, খায়বার, ফদক ইয়ামেন এমন কি সুদূর ফিলিস্তিন, সিরিয়াতেও তাঁহার সন্তানগণ ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু ইহাদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মক্কাতেই। তবে সেই আদম যুগের মক্কা যে এখনকার মক্কা হইতে অনেক বড় এবং জনবহুল ছিল, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।
এক হাজার বৎসরে আওলাদে আদমের সংখ্যা কত হইয়াছিল তাহার সঠিক শুমারী জানা না থাকিলেও অনুমান করা হয়। তাহাদের সংখ্যা কয়েক লাখের ঘর ছাড়াইয়া গিয়াছিল।
শেষ পর্যায়ে দূর-দূরান্তের মানুষ যখন শুনিত যে, বেহেস্ত হইতে দুনিয়াতে আগমনকারী আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া এখনও জীবিত আছেন, তখন তাহারা কাবা জিয়ারত এবং আদি মাতা পিতা দর্শনাশে মক্কায় আসিত। হজ¦ও করিয়া যাইত। অবশ্য তখনকার দিনের হজ শুধু কাবা জিয়ারত এবং উকুফে আরাফাতেই ছিল সীমাবদ্ধ।
এই সব কারণে মক্কা তখনও ছিল সারা বৎসরই জমজমাট এবং গড়িয়া উঠিয়া ছিল ব্যবসাকেন্দ্র।
মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে বিবি হাওয়া জিদ্দায় চলিয়া গিয়াছিলেন এবং সেখানেই ইনতিকাল করেন। জিদ্দাতেই তাহার মাজার অবস্থিত অতঃপর হযরত আদম (আ.)-এর ইনতিকাল হয়। তাকে ইরাকে সমাহিত করা হয়।


ফারাত তানুর ১১ : ৪১-৪২
রব হুকুমে জমিন হইতে
উঠছে পানির স্রোত আর বান
আকাশ ঘিরে আইল ধাইয়া
বৃষ্টি প্লাবন ঝড় তুফান!!
নূহ নবীকে কয় আল্লায়!
এইবার উঠ এই নৌকায়!!
লও প্রাণীদের জোর সবার,
লইবে তোমার পরিজনকে
আর যাহারা ঈমানদার!!
কন্ নুহু সব উঠ নৌকায়
নাম লইয়া হু মেহেরবান!! ঐ
নৌকা আমার এর গমন
কিংবা কোথায় থামবে খন!!
মরজি আল্লার, আমার জয়
ক্ষমাশীল আর দয়াল বন্ধু
আমার প্রভু সুনিশ্চয়!
ঢেউয়ের বুকে পাহাড়সম
চলল নুহুর সে শাম্পান!! ঐ

হযরত আদম (আ.)-এর মৃত্যুর পর হইতে হযরত নূহ (আ.) পর্যন্ত আওলাদে আদম এত বৃদ্ধি পাইল যে তাহারা শুধু শুনিত যে আদম হাওয়া আমাদের আদি পুরুষ এবং মক্কা আমাদের আদি ভূমি। ততদিনে আওলাদে আদম ইরাক, ইরান, ভারত, আফগানিস্তান, এশিয়া মাইনর, তুর্কিস্থান, পূর্ব ইউরোপ এবং মিশর, উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তখনও ধর্মভীরুগণ হজ পালন করিতে মক্কায় আসিত।
হযরত আদম (আ.)-এর মৃত্যুর মাত্র ৫৬ বৎসর পরে হযরত নূহ (আ.)-এর জন্ম হইল। তাহার নছবনামা ছিল হযরত নূহ ইবনে লমক ইবনে মুতাওয়াশলাখ ইবনে আফতুহ, ইবনে বিয়ার ইবনে ছালাইল, ইবনে কায়তান, ইবনে আনুশ, ইবনে শীশ, ইবনে আদম (আ.)। যদিও তাঁহার জন্মস্থান ছিল ইরাকের মসুলে। কিন্তু তাহার কিবলা কাবার দিকেই ছিল এবং তিনি হজ করিতে মক্কায় আসিতেন। তিনি দীর্ঘদিন তাহার জাতিকে ইসলামে আহ্বান করিলেন। কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষই ঈমান আনিল। তাহারা তাহাকে নানাভাবে বিরক্ত করিত এবং কষ্ট দিত, মারধর করিত। অগত্যা তিনি জাতির ধ্বংস কামনা করিলেন।
হযরত নূহ (আ.)-এর প্রতি আল্লাহর হুকুম হইল,
‘ওয়াছনাঈল ফুলকা।’ আপনি নৌকা তৈরী করুন।
হযরত জিব্রাইল (আ.)-এর সহায়তায় তিনি ৩০০ গজ লম্বা ৫০ গজ প্রস্থ এবং ৩০ গজ উঁচু তিন তলা বিশিষ্ট একটি বিশাল নৌকা তৈয়ার করিয়া ফেলিলেন। তখন তাহার বয়স ৬০০ বৎর।
বৎসর কুফার জামে মসজিদের সংলগ্ন স্থানেই তিনি নৌকার পত্তন করিয়াছিলেন এবং মসজিদের দরজাটার স্থানেই ছিল তাহার ‘ফারাত তানু’ যা রুটি সেঁকিবার তানুর বা তন্দুর বা চুলা।
আগেই আল্লাহ বলিয়া রাখিয়াছিলেন, যেদিন তাহার তানুর হইতে পানি বলকাইয়া উঠিবে, সেই দিনই শুরু হইবে মহাপ্লাবন।
১০ই রজব। তানুর হইতে পানি উঠিতে লাগিল। প্লাবন সংকেত। হযরত নূহ আল্লাহর নির্দেশে প্রত্যেক প্রাণীর (স্থলচর, খেচর) এক জোড়া করিয়া নৌকায় উঠাইলেন। আর উঠাইলেন তাহার পরিজন এবং মুসলমানদের। তাহার তিন পুত্র হাম, শাম, এয়াফেজ এবং তাহাদের স্ত্রীরাও নৌকায় উঠিল। কিন্তু অপর পুত্র কেননা নৌকায় উঠিল না। সে পিতার আহ্বান উপেক্ষা করিয়া এক পাহাড়ের গর্তে যাইয়া আশ্রয় নিল। সেখানেই সে তাহার মলমুত্রের মধ্যে ডুবিয়া চরিয়াছিল।
সর্বমোট ৮০জন ঈমানদার যাত্রী লইয়া নৌকা ভাসিয়া উঠিল। মাটি হইতে বলকানো পানি, আকাশের মুষলধার বৃষ্টি। দুনিয়া পানিতে সয়লাব হইয়া গেল।
বন্যার পানিতে কাবা বা বাইতুল্লাহ ডুবিয়া গেল, মক্কা ভাসিয়া গেল। কিন্তু সেই স্বর্গীয় প্রস্তরখণ্ড হজরে আছওয়াদের মর্যাদা আল্লাহ পাক ঠিকই রক্ষা করিলেন। আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিব্রাইল (আ.) হাজরে আছওয়াদ কাবা হইতে উঠাইয়া নিয়া জাবালে আবু কুবায়েছের উচ্চ স্থানে রাখিয়া দিলেন। সেখানে বন্যার পানি উঠিল না।
যাত্রী লইয়া নৌকা দুনিয়াময় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। উত্তাল তরঙ্গমালায় নৌকার কোন ক্ষতিই করিতে পারিল না। বরং ‘ফি মাউজীন কাল জিবাল’ ঢেউয়ের বুকে পাহাড়সময় চলল নুহুর সে শাম্পান।
৯ই জিলহজ আসন্ন। বন্যাও কমিতেছে না। তবে কি এইবার মুষ্টিমেয় মোমেনগণ হজ করিবে না? করিবে। আল্লাহ তার ব্যবস্থা করিলেন।
নৌকা ভাসিয়া আসিল খানায়ে কাবার স্থানে। এবং যাত্রী লইয়া সাতবার তোয়াফ করিল নিমজ্জিত কাবার চারিপাশে। নৌকা ভাসিয়া গেল আরাফাতেও। অবস্থান করিল আছর পর্যন্ত। প্রবল বন্যাতেও মহান আল্লাহ এইভাবে কাবা এবং হাজরে আছওয়াদের মর্যাদা রক্ষা করিলেন। মোমেনদের হজ করাইলেন।
বর্তমানের জুদী পাহাড়ে যাইয়া হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা ঠেকিল। বন্যার পানিও গেল কমিয়া। দীর্ঘ ছয়টি মাস তিনি নৌকায় কাটাইয়া ১০ই মহরম লোকজন লইয়া মাটিতে নামিলেন।
এই ৮০জন ছাড়া তামাম দুনিয়াতে আর মানুষ নাই। ইহাদের হইতে আবার দুনিয়া আবাদ শুরু হইল। এই জন্যই হযরত নূহকে বলা হয় আদমে ছানী বা দ্বিতীয় আদম। ইহার পরেও হযরত নূহ (আ.) ৩৫০ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন।
বর্তমানের আফ্রিকায়, হযরত নূহ (আ.)-এর পুত্র হাম, তুরস্ক এবং ইউরোপ খণ্ডে ইয়াফেজ এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উপমহাদেশীয় দেশে শামের বংশধরগণ বাস করে।


ইন্নি আছকান্তু ১৪ : ৩৭
হাজেরাকে দেন বনবাস
আল্লার নবীনাম খলীল;
সঙ্গে তাহার যান রাখিয়া
শিশুপুত্র ইছমাইল!! ঐ
খলীলুল্লাহ বলেন সাঁই!
সন্তান আমার রাইখ্যা যাই!!
তোমার ঘরের সন্নিধান?
বন জংগল আর মরুর বলি
হয় না আবাদ যে ময়দান!!
শুধুই বালি মরিচীকা
নাই তো কোথায় পয়-সলিল!! ঐ
নামায তাদের কায়েম হোক!
আর জগতের অনেক থোক!!
ইহার দিকেই মুখ ফিরাও!
আর তাদেরে এই বিয়ানে
ফল মেওয়াতে আহার দাও!!
করবে তারা তোমার শুকুর
ওগো আল্লাহু রাব্বিল!! ঐ

মহাপ্লাবনে মক্কা বিধ্বস্ত হইলেও খানাকে কাবার ভিত্তিমূল টিকিয়া ছিল, কিন্তু বন্যার স্রোতে মূল ঘরের ক্ষতি সাধিত হইয়াছিল। ঢাকা পড়িয়া গিয়াছিল জমজমের উৎস, বন্ধ হইয়া গিয়াছিল মক্কার অন্যান্য কূপগুলি।
হযরত নূহ (আ.) ক্ষতিগ্রস্ত কাবায় দুই একবার হজ করিতে আসিয়াছিলেন বটে! কিন্তু পানিবিহীন স্থানে টিকিয়া থাকিতে না পারিয়া দুই একদিন পরেই চলিয়া যাইতেন। তাহার মৃত্যুর পর মানুষ পুনরায় বিধর্মী হইয়া যাওয়ায় মক্কায় আর কেহ আসিত না। কালে ভদ্রে দুই একটি কাফেলা আসিয়া কাবা তোয়াফ করিয়াই আবার চলিয়া যাইত। কেহ আর এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করিবার চিন্তা করিত না।
হযরত আদম (আ.)-এর মৃত্যুর ২৩০৮ বৎসর পর এবং হযরত নূহ (আ.)-এর মহা প্লাবনের ১৬৫২ বৎসর পর তাবেল শহরে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্ম হয়। তাহার নছবনামা নিম্নরূপ।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) ইবনে আজর, ইবনে নাছুর, ইবনে শারেক, ইবনে মারউব, ইবনে ফালেখ, ইবনে আবের, ইবনে শালেখ, ইবনে আরফাখশাদ, ইবনে শাম, ইবনে নূহ, ইবনে লমক, ইবনে মুতাওয়াশলাল, ইবনে আফতুন, ইবনে বিয়াব, ইবনে ছালাইল, ইবনে কায়তান, ইবনে আনুষ, ইবনে শীশ, ইবনে হযরত আদম (আ.)।
নারে নমরূদ বিজয়ী মুত্তাকী, নমরূদ বিজয়ী নবী আল্লাহর খলীল হযরত ইব্রাহীম (আ.) জানিতেন, কাবা বা বাইতুল্লাহ কোথায় অবস্থিত। তাই যখন আল্লাহর নির্দেশ আসিল যে, শিশুপুত্র ইসমাঈলসহ বিবি হাজেরাকে কাবাঘরের সন্নিকটে নির্বাসন দাও; তখন তিনি এক থলি গম এবং এক মশক পানিসহ স্ত্রী পুত্রকে হালকা বনবেষ্টিত, নির্জন স্থানে, ক্ষতিগ্রস্ত কাবার সন্নিকটে রাখিয়া চলিয়া যাইতেছেন দেখিয়া বিবি হাজেরা জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কি আমাদেরকে আল্লাহর হুকুমে এখানে রেখে যাচ্ছেন?
হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলিলেন, হ্যাঁ।
বিবি হাজেরা আর কিছুই বলিলেন না। কারণ তিনি জানেন যে, আল্লাহর নির্দেশে যখন আমাদেরকে এখানে রাখিয়া যাইতেছেন তবে আর দুশ্চিন্তার কারণ নাই। মহান আল্লাহই আমাদেরকে হেফাজত করিবেন। আমাদের উছিলায় আল্লাহ এখানে নিশ্চয়ই কোন মহান কার্য্য সাধন করিবেন, তাই এই ব্যবস্থা।
এখন হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর বয়স ৯৯ বৎসর। তিনি স্ত্রী পুত্রকে কাবার সন্নিকটে রাখিয়া আসিয়া খানায়ে কাবায় দুই রাকাত নামাজ পঘিয়া দোয়া করিলেন। ইহাই তাহার প্রথম দোয়া।
‘হে আমার রব! আমি আমার বংশধরকে আপনার ঘরের সন্নিকটে এমন একটি ময়দানে রাখিয়া যাইতেছি, যাহা কৃষি কাজের উপযোগী নহে। হে আমার রব! তাহারা যেন নামাজের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখে। এবং আপনি কিছু সংখ্যক লোককে তাহাদের প্রতি আকৃষ্ট করিয়া দিন এবং ফল ফলন্তি দ্বারা তাহাদের রিজিক দান করুন। যেন তাহারা শুকরীয়া আদায় করে।’ ১৪/৩৭
ইহার পর হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর উপর নির্দেশ হইল, তিনি যেন শ্যাম দেশ ছফর করেন। ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক মাত্রই জানেন যে, বর্তমানের থাইল্যান্ডই ছিল শ্যামদেশ এবং সিরিয়াও ছিল শ্যামদেশ। হযরত ইব্রাহীম (আ.) যে সিরিয়াতে যান নাই। গিয়াছিলেন থাইল্যান্ডে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইহা এখন সর্বজন বিদিত যে, হযরত ইব্রাহীম (আ.)কেই বলা হইত ব্রহ্মা। তিনি ইরাক, ইরান, ভারতবর্ষ হইয়া শ্যামে পৌঁছিয়া ছিলেন। যাওয়া আসার পথে তিনি যে দেশে কিছুদিন অবস্থান করিয়া ছিলেন। সেই দেশের নামই হইল ব্রহ্মার দেশ বা ব্রহ্মদেশ (বর্তমানের মায়ানমার)। ছফরের সময় তিনি দেখিয়া গিয়াছিলেন সিন্ধু তীরের উর্বরতা। এবং শস্য শ্যামলরূপ। তাই তাহার তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তানদের বলিয়া গিয়াছিলেন, যেন তাহারা সিন্ধু তীরে যাইয়া বসবাস করে।
একদিন শেষ হইয়া গেল বিবি হাজেরার যৎসামান্য গম এবং এক মশক পানি। এখন উপায়? বিবি হাজেরা খাদ্য ও পানীয়ের আশায় একবার উঠেন ছাফা পাহাড়ে একবার উঠেন মারওয়া পাহাড়ে। খুঁজেন খাদ্য-পানীয়। কিন্তু কোন পাহাড়েই খাদ্য পানীয় পাইলেন না।
ছাফাতে উঠিয়ে পশ্চিম দিকে চাহিয়া দেখেন শিশুপুত্রকে দেখা যায় কি না। হ্যাঁ, দেখা যায়। শিশু হাত পা নাড়িয়া খেলা করিতেছে। মারওয়ায় যাওয়ার সময় মাঝখানের সমতল জায়গাটুকু তাড়াতাড়ি অতিক্রম করিবার জন্য একটু দৌড় করিয়া যান। মারওয়ায় উঠিয়া পশ্চিম দিকে চাহিয়া দেখেন শিশুকে দেখা যায় কি না। হ্যাঁ, ঐ তো দেখা যায় হাত-পা নাড়িয়া শিশু খেলায় মত্ত।
দুইটি পাহাড়ে সাতবার উঠানামা করিয়াও কোন ফল হইল না দেখিয়া মা পাগলিনী ছুটিলেন শিশুর কাছে। শিশু নিরাপদে আছে কি না দেখিতে হইবে। তারপরে আবার বাহির হইবেন খাদ্য ও পানীয়ের তল্লাশে।
শিশুর কাছে যাইয়া দেখেন কি? আশ্চর্য! আল্লাহর কুদরত বুঝিবার সাধ্য মানুষের নাই। শিশুর পায়ের গোড়ালীর দাপাদাপিতে কঠিন মাটি ফাটিয়া কুল কুল ধারায় পানি বাহির হইতেছে। একদম পরিষ্কার মিষ্টি পানি। তাহার আনন্দ দেখে কে? তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করিলেন। মাটি ডলিয়া কাদা বানাইয়া বাঁধ দিলেন চারিদিকে। পানি আটকিয়া কূয়ার মত হইয়া গেল। বহু কাল পর পুনরায় জারি হইল জমজম। আল্লাহর হুকুমে শিশু ইসমাইলের গোড়ালীর দাপাদাপীকে উছিলা করিয়া হযরত আদম (আ.) এর সেই স্বর্গপ্রাপ্ত ঝরনা, যাহা হযরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনে চাপা পড়িয়া গিয়াছিল, তাহা পুনরায় জারি হইয়া গেল।
পানি সমস্যা দূর হইল। এখন রহিল আবাসিক ও খাদ্যসমস্যা। মহান আল্লাহ সেই ব্যবস্থাও করিয়া দিলেন।
একটি বাণিজ্য কাফেলা ইয়ামেন হইতে সিরিয়া যাওয়ার পথে হঠাৎ কাবায় আসিয়া উপস্থিত হইল। উদ্দেশ্য, যাওয়ার পথে কাবা তোয়াফ করিয়া যাওয়া। এই কাফেলাটি এই পথে আরও কায়েকবার আসা যাওয়া করিয়াছে এবং কাবায়ও আসিয়াছে। কিন্তু কোনদিন তাহারা এখানে মানুষ দেখে নাই। আজ হঠাৎ সেখানে মানুষ দেখিয়া বিশেষ করিয়া একটি মেয়ে লোক এবং দুগ্ধ পোষ্য শিশু দেখিয়া তাহারা খুবই বিস্মিত হইল!
তাহারা বিবিব হাজেরার কাছে গেল এবং আরও বেশী আশ্চর্য্য হইল একটি মিষ্টি পানির ঝরনা দেখিয়া কাবা তোয়াফ করিয়াই তাহারা এই পানিবিহীন স্থান ছাড়িয়া চলিা যাইবে। ইহাই ছিল তাহাদের ধারণা এবং বরাবরের অভ্যাস। কিন্তু আজ এখানে পানি দেখিয়া আল্লাহর ঘরের কাছে কয়েকদিন থাকিয়া যাইবার জন্য তাহাদের বড় ইচ্ছা হইল।
কাফেলার সর্দার ছিলেন একজন ধার্মিকজন। তিনি বিবি হাজেরার সঙ্গে রফা করিয়া ফেলিলেন, কাফেলা লইয়া তিনি যে কয়দিন এখানে থাকিবেন, সে কয়দিন বিবি হাজেরা তাহাদেরকে প্রয়োজনীয় পানি দিবেন, তাহারাও তাঁহাকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করিবেন।
খাদ্যসমস্যা সমাধান হইল। পরের দিন সর্দার ইনফিতার যখন জানিতে পারিলেন যে, বিবি হাজেরা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর স্ত্রী, তখন তিনি ভক্তিতে গড়াইয়া পড়িলেন। কারণ ইনফিতার ছিলেন একজন মুসলমান। তিনি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কাছেই দ্বীন শিখিয়াছেন।
ইনফিতার তৎক্ষণাৎ তাহার অতিরিক্ত ছামান হইতে একটি তাঁবু বাহির করিয়া খাটাইয়া দিলেন। তিনি বিবি হাজেরাকে অনুরোধ করিলেন যেন শিশুপুত্রকে লইয়া তাঁবুতে বসবাস করেন। বিবি হাজেরা ইনফিতারের অনুরোধ রক্ষা করিলেন।
কয়েকদিন পর ইনফিতার সিরিয়া যাওয়ার সময় তাহার নিজস্ব পরিচারিকা আফসানাকে বিবি হাজেরার পরিচর্যার জন্য রাখিয়া গেলেন। রাখিয়া গেলেন প্রচুর পরিমাণ খাদ্য। তিনি বলিয়া গেলেন, ফেরৎপথেও তিনি মক্কা হইয়াই যাইবেন।
ইনফিতার সিরিয়া যাওয়ার পথে তাহার সঙ্গে রাস্তায় সাক্ষাৎ হইল ইয়ামেনগামী একটি বাণিজ্য কাফেলার সাথে। তিনি কাফেলাকে বলিয়া দিলেন, কাবায় এখন প্রচুর মিষ্টি পানির ব্যবস্থা আছে। এই কাফেলাটিও ইয়ামেন যাওয়ার পথে কাবার আসিল এবং বিবি হাজেরার সঙ্গে পানির একটি রফা দফা করিয়া সাপ্তাহ দিন এখানেই কাটাইয়া গেল। সিরিয়া হইতে ফেরৎ পথে আবার আসিলেন ইনফিতার। কয়েকদিন থাকিয়া তিনি দেশে ফিরিয়া গেলেন বটে! কিন্তু আফসানাকে আর সঙ্গে নিলেন না। হেবা করিয়া দিয়া গেলেন বিবি হাজেরাকে। আফসানাও এই ব্যবস্থায় খুব খুশী হইল।
এমনিভাবে বিভিন্ন কাফেলার মাধ্যমে ইয়ামেন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিশর, ইরাক এবং সমগ্র আরবে খবর ছড়াইয়া পড়িতে লালিগল যে কাবায় এখন প্রচুর সুপেয় পানির ব্যবস্থা আছে, যাহার সত্ত্বাধিকারী একজন মহিলা এবং তাহর শিশুপুত্র।
কাবায় আসিতে লাগিল কাবা জিয়ারতকারী শত শত কাফেলা। পানি বিক্রি করিয়া বিবি হাজেরার আয় হইতে লাগিল প্রচুর। ইহাতে মাতাপুত্র এবং আফসানার গ্রাসাচ্ছাদন চলিয়াও উদ্বৃত্ত হইতে লাগিল। হইল ঘরদোরের ব্যবস্থা।
এখন বিরান মক্কায় প্রচুর লোক সমাগম। সুবিধা হইল ব্যবসা-বাণিজ্যের। বসিতে লাগিল দোকনপাট, হাট-বাজার। গড়িয়া উঠিতে লাগিল সরাইখানা, মুসাফিরখানা। বাসিন্দারা নির্মাণ করিল স্থায়ী বাড়ীঘর। গড়িয়া উঠিতে লাগিল আবার মক্কা নগরী। সৌভাগ্যের দরজা খুলিয়া গেল বিবি হাজেরার। তিনি এখন মক্কার শাসনকর্তা।
মানুষ ধরিয়া নিয়াছে তাহারা সবাই বহিরাগত। একমাত্র বিবি হাজেরাই মক্কার স্থায়ী বাসিন্দা। কাজেই পানি সংকট হইতে আরম্ভ করিয়া যে কোন সংকট সমস্যার জন্য সমাধান ফায়ছালা নিতে সবাই ছুটিয়ে আসে বিবি হাজেরার কাছে। সবাই একবাক্যে মানিয়া নেয় তাহার মীমাংসা।
আফসানার আনন্দ আর ধরে না। কাজকর্ম সারিয়া সে শিশু ইসমাঈলকে কোলে লইয়া নতুন শহর ঘুরিয়া বেড়ায়। কাঁধে করিয়া ফিরিয়া আসে। কাফেলায় কাফেলায় ছুটিয়া বেড়ায়।
যাহা তাহা লোকের পুত্র নয় এই শিশু। নবীর পুত্র। হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র। কাজেই শিশুর কোলের অভাব নাই, আদরের কমতি নাই। সবাই কোলে টানিয়া নেয়। ভরিয়া তোলে আদরে সোহাগে। এমনিভাবে সকলের কোলে-কোলে, আদরে-সোহাগে শিশু ইসমাঈল বালক ইসমাঈল হইল উঠিলেন।
ইসমাঈল জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার আব্বু কে, আম্মি?
বিবি হাজেরা বলিলেন, তোমার আব্বু আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহীম (আ.)।
ঃ তিনি এখন কোথায়? আসেন না কেন?
ঃ তিনি আল্লাহর নির্দেশে কোন দিকে ছফরে গেছেন, তা জানি নে বাপি, তবে তিনি আসবেন। অচিরেই আসবেন। তোমাকে দেখতে আসবেন।
ঃ তিনি এসে আমাকে আদর করবেন না?
ঃ নিশ্চয়ই আদর করবেন। কোলে নিবেন।
আমি কিন্তু তখন তাঁকে আর কোথাও যেতে দিব না, আম্মি। আমি তাঁর সাথে থাকব, যা বলবেন, স-ব কথাই মানব।
বিবি হাজেরা ছেলের গণ্ডে চুমো খাইয়া বলিলেন, তুমি আমার লক্ষ্মী ছেলে। মানবে, অবশ্যই তার সব কথাই মানবে।
বিবি হাজেরা অবসর সময়ে গল্প বলেন, বলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর নমরূদের বাড়ীতে থাকার কথা। বলেন তর্কে নমরূদকে হারাইয়া দিবার কাহিনী, বলেন মূর্তী ভাঙ্গার কথা। শুনা অগ্নি হইতে তাহার বাঁচার ইতিবৃত্ত। শুনান নমরূদের মৃত্যুর করুণ ইতিহাস। মনপ্রাণ দিয়া শুনিয়া যান বালক ইসমাঈল। শুনে আফসানা।
বালক ইসমাঈল পিতার কাহিনী শুনেন আর কল্পনা করেন, কেমন ছিল বাদশা নমরূদ, কেমন বিরাট ছিল তাহার অগ্নিকুণ্ড। কত লক্ষ কোটি মশা আসিয়াছিল নমরূদ বাহিনীকে ধ্বংস করিতে। কেমন আমার আব্বি? তিনি দেখিতে কেমন? আমার আব্বি নিশ্চয়ই খুব সুন্দর এবং ভাল। নইলে আগুনে পুড়লেন না কেন? আহা! আল্লাহ যদি আমাকেও আমার আব্বির মত বানাইতেন! ইত্যাদি কল্পনার কিশলয়গুলি কচি মনে সবুজ হইয়া শাখা-প্রশাখা বিস্তার করিতে থাকে।
একদিন বালন ইসমাঈল ছাফা পর্বতের পাদদেশে ছায়ায় বসিয়া ভাবিতেছেন আকাশটা যেহেতু অনেক বিরাট, তবে নিশ্চয়ই আকাশের সৃষ্টিকর্তা আরও বিরাট। সূর্যের আলো যেহেতু দুনিয়ার সমস্ত অন্ধকার দূর করিতে পারে তবে ষূর্যের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নূরের তাজাল্লী নিশ্চয়ই মানুষের মনের সমস্ত অন্ধকার দূর করিতে পারে। যে চাঁদের আলো এত মিষ্টি সেই চাঁদের সৃষ্টিকর্তা কত যে মধুময় তা বলিবার অপেক্ষা রাখে না।
বালক আরও ভাবিতেছেন, তরমুজের ভিতর এত সুমিষ্ট পানি, খেজুরের মধ্যে এত মিষ্টি আর সুগন্ধি, নাশপাতি, আপেল, আংগুরে এত সুস্বাদ যিনি ভরিয়া দিতে পারিয়াছেন তিনি বেহেস্তের মেওয়াগুলি যে কত অধিক সুস্বাদু করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন তাহা বুঝাই যায়।
তিনি আরও ভাবিতেছেন, আল্লাহর অসীম ক্ষমতা। নইলে তাহার হুকুম পাইয়াই নমরূদের অগ্নিকুণ্ডটা আব্বুর জন্য ঠাণ্ডা হইয়া গেল কেন? যে মশাগুলি তিনি নমরূদের সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করিবার জন্য পাঠাইয়া ছিলেন, সেইগুলি নিশ্চয়ই কোন পাহাড়ে বন্দি ছিল। পাহাড়ের দরজা খুলিয়া দিতেই বাহির হইয়া আসিল ঝাঁকে ঝাঁক লাখে লাখ মশা।
ঠ্যাং ভাঙ্গা যে মশাটা নমরূদের নাম দিয়া ঢুকিয়াছিল সে কি করিয়া চিনিয়াছিল যে এই ব্যাটাই নমরূদ। আহা! আল্লাহ দাবীদার মহা পরাক্রমশালী নমরূদ ঠ্যাং ভাঙ্গা এক মশার কামড়ে অস্থির হইঅয়ছিল। আচ্ছা! মশাটা যখন নমরূদের তালুতে কামড়াইতে থাকিত, আর একজন চাকর জুতা দিয়া তাহার মাথায় ঠুকিতে থাকিত, তখন কেমন দেখা যাইত? নমরূদের চেহারাটা তখন কেমন দেখাইত? নিশ্চয়ই তাহার মুখটা তখন বাঁকিয়া তেরা হইয়া যাইত। দৃশ্যটা কল্পনা করিয়া বাল্যসুলভ কৌতুকে বালক আর হাসি সংবরণ করিতে পারিলেন না। তিনি হাসিয়া উঠিলেন।
একজন বৃদ্ধ তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, তুমি একাই হাসছ কেন খোকা?
তাহার কল্পনায় আত্মভোলা হইয়া থাকার সময়ে কখন যে এই অজ্ঞাত পরিচয় বৃদ্ধ তাহার পাশে আসিয়া বসিয়াছেন তাহা বালক ইসমাঈল টের পান নাই।
এইবার তিনি বৃদ্ধের দিকে চাহিয়া বলিলেন, হাসছি নমরূদের মুখটা কল্পনা করে। যখন তার তালুতে মশা কামড়াচ্ছিল, আর চাকর তার মাথায় জুতো দিয়ে ঠুকতে ছিল, তখনতার মুখটা কেমন দেখাচ্ছিল তাই ভেবে হাসছি। খুব খারাব দেখাচ্ছিল, তাই না?
বৃদ্ধ বলিলেন, হ্যাঁ, খুব খারাব দেখাচ্ছিল।
ঃ আপনি কি তখন দেখেছিলেন নমরূদের মুখের অবস্থা!
ঃ হ্যাঁ, দেখেছিলাম।
ঃ কেমন করে?
ঃ আমি যে তখন সেখানে ছিলাম!
বালক বৃদ্ধের মুকেল দিকে চাহিয়া বলিলেন, নমরূদের ভূতখানায় ভূতগুলি যখন আমার আব্বি পিটিয়ে ভেঙ্গে ছিলেন, আর তিনি কি বলেছিলেন, তা আপনি জানেন কি?
বৃদ্ধ বলিলেন, হ্যাঁ, জানি। এই বলিয়া বৃদ্ধ বালক ইছমাঈলকে টানিয়া কোলে তুলিয়া লইয়া বলিলেন, তিনি মন্দিরে যেয়ে দেখেন মূর্তিগুলির সামনে খানা সাজানো রয়েছে। তিনি মূর্তিদের বললেন, খাও! খানা খেয়ে নাও। কিন্তু তারা খানা খেল না। এবার বললেন, খানাও খাচ্ছ না, কথাও বলছ না কেন? বল! কথা বল। কিন্তু ভূতেরা কথাও বলল না। অমনি তিনি ভূতগুলি পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেললেন।
বালক বলিলেন, আপনি দেখি আমার আব্বির অনেক কথাই জানেন। তবে বলুন তো! তিনি নমরূদের অগ্নিকুণ্ডে কয়দিন ছিলেন?
বৃদ্ধ কম করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, সাতদিন ছিলাম আব্বি।
ইছমাইল আবেগে বৃদ্ধের গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন, আব্বি! আমার আব্বি। হযরত ইব্রাহীম (আ.)ও ছেলেকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া চলিলেন।
খাওয়ার সময় অতিক্রান্ত হইয়া যাইতেছে, অথচ এখনও ছেলে বাড়ীতে ফিরিতেছে না দেখিয়া বিবি হাজেরার মনপ্রাণ হাহাকার করিয়া উঠিল। তিনি আফসানাকে বলিলেন, আফসানা, বাছামনি কোথায় গেল, খুঁজে নিয়ে আয়। খাবার সময় যে গড়িয়ে যাচ্ছে।
আফসানা ইছমাইলকে খুঁজিতে বাহির হইল এবং কিছুক্ষণ পরে হাঁপাইতে হাঁপাইতে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আম্মি! ইছমাইল ভাইকে এক বৃদ্ধ কোলে নিয়ে বসে শুধু কেঁদে চলছেন, ভাইও বৃদ্ধের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।
বিবি হাজেরা চমকিয়া উঠিলেন, ওমা! বলিস কিরে! কোথায়! চলতো দেখি?
তাহারা চলিলেন ছাফার পাদদেশে। কিন্তু রাস্তায় দেখা হইয়া গেল, পিতার কাঁধে চড়িয়া পুত্র বাড়ীতে ফিরিতেছে। সে এক আনন্দ, সে এক মউজ।
শ্যাম ছফর শেষ করিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাবায় আসিয়াছেন। বাবেল যাইবার পথে দেখিয়া যাইবেন স্ত্রী পুত্র কেমন আছে। কাবায় পৌঁছিয়া তিনি আশ্চর্য্য হইয়া গেলেন। আল্লাহর কুদরতকে বুঝিতে পারে। এই বিয়াবান এখন আবারো হারানো মক্কায় আবাদ হইতে চলিয়াছে। সব শুনিয়া সব দেখিয়া তিনি আল্লাহর শুকরীয়া আদায় করিতে লাগিলেন।
আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহীম খলিল মক্কায় ফিরিয়া আসিয়াছেন শুনিয়া লোকজন তাহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিতে লাগিল। তিনিও সকলের সঙ্গে মিলিত হইয়া আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করিতে লাগিলেন, শুনাইতে লাগিলেন তাহার ছহিফার শিক্ষা। নতুন করিয়া চলিতে লাগিল ইসলামের অনুশীলনী। বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করিয়া ধন্য হইলেন।
বালক ইছমাইল পিতার কাছে শিখিতে লাগিলেন তার উপর অবতীর্ণ ছহিফাগুলি। তিনি অল্প দিনেই হইয়া গেলেন হাফেজে ছহিফা।
স্বগোত্রীয়দের মাঝে দ্বীন প্রচার এবং নতুন করিয়া অবতীর্ণ ছহিফার শিক্ষাগুলি তাহাদেরকে জ্ঞাত করাই যার জন্য হযরত ইব্রাহীম (আ.) কিছুদিনের জন্য বাবেল চলিয়া গেলেন। পুত্র ইছমাইল সঙ্গে যাইতে চাহিলে তিনি তাহাকে কিছুতেই সঙ্গে নিলেন না। কারণ কাবা বা বায়তুল্লাহর নিকট হইতে ছেলেকে দূরে লইয়া যাওয়া তাহার মনঃপুত হইল না। দ্বিতীয়ত বিবি হারের মনঃকষ্টের কারণ হইবে ভাবিয়া। হযরত ইছমাইল এখন আর নিতান্ত বালকটি নহেন। দশ এগার বৎসরের কিশোর। বুঝেন মোটামুটি অনেক কিছুই। তাই তিনিও আর বাবেল যাওয়ার জিদ ধরিলেন না।
পিতৃবিরহে কান্না করুণ ইছমাইলকে হযরত ইব্রাহীম (আ.) প্রবোধ সান্ত্বনা দিয়া বলিয়া গেলেন, কেঁদো না আব্বি, এই তো আমি এলাম বলে।


আন্নি আজবাহুকা ৩৭ : ১০২
বালক ইছমাইলকে কোলে
লইলেন পিতা ইব্রাহীম,
বলেন পিতা ইছমাইলকে
শুন কি কন রব রাহীম!!
বলেন আরøাহ মেহেরবান!
প্রাণের বস্তু দাও কোরবান!!
স্বপ্নে আমি দেখনু তাই!
আল্লাহর নামে কোরবানীতে
তোমায় আমি দেই জবাই!!
চল এবার রায় কি তোমার
ওগো পুত্র প্রাণপ্রতীম!! ঐ
কন ইছমাইল আব্বাজান!
আপনি আমায় দেন কোরবান!!
পাইলেন আপনি যেই আদেশ!
করুন পালন হৃষ্ট চিত্তে
আর দেরী নয় এক নিমেষ!!
ইনশাল্লাহু আপনি আমায়
পাইবেন ধৈর্যশীল অসীম!!ঐ
কিছুদিন পরেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) বাবেল হইতে মক্কায় ফিরিয়া আসিলেন। রাত্রে বিবি হাজেরা এবং পুত্র ইছমাইলকে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, একটি বিশেষ কথা বলার জন্যই তোমাদেরকে ডেকেছি। আল্লাহ মহান আমাকে একটি বিশেষ কাজ করার আদেশ করেছেন। কিন্তু কাজটি তোমাদের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া আমার দ্বারা করা সম্ভব নয়। তিনি ইছমাইলকে কোলে টানিয়া নিলেন।
মাতাপুত্র একসাথে বলিলেন, বলুন কী কাজ? আমরা সর্বোতভঅবে সহযোগিতা করব আপনাকে।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলিলেন, আল্লাহ আমাকে নির্দেশ করেছেন আমার সবচেয়ে প্রিয়বস্তু তাঁর নামে কোরবানী করতে। আমার প্রিয় বস্তু কী, তা ভেবে পাচ্ছি না। পর পর তিনদিন একই নির্দেশ আমি স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত হই। এরপর স্বপ্নে দেখি, আমি তোমাকেই কোরবানী করিতেছি হে পুত্র। এবার বল বাপি, তোমার অভিমত কী?
বিবি হাজেরাকে লক্ষ্য করিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলিলেন, তোমার অভিমতও আমার জানা দরকার।
বিবি হাজেরা বলিলেন, শিশুপুত্রসহ যখন আমাকে এখানে রেখে গিয়েছিলেন, তখন যেমন আমি আল্লাহর ইচ্ছাকেই মেনে নিয়েছিলাম, এখনও আমি আল্লাহর ইচ্ছাকেই মেনে নিলাম।
হযরত ইছমাইল লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমাকে পছন্দ করেছেন, কবুল করেছেন। এর চেয়ে বড় পাওনা আমার জন্য আর কী হতে পারে? আপনি আমাকে সন্তুষ্ট চিত্তে কোরবানী দিন। আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ আমি ধৈর্য্য ধারণ করব।
বিবি হাজেরা বলিলেন, কাল সকালেই তোমাকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হবে বাপি! ইহকালে আমি তোমাকে কোনদিন দেখতে পাব না। কাজেই আস, শেষবারের মত আজ সারারাত তোমাকে বুকে নিয়ে কাটাই।
বিবি হাজেরা ছেলেকে বুকে নিয়ে শুইলেন। তিনি কাঁদেন না। শুধু ছেলের গায়ে হাত বুলাইতেছেন আর বলিতেছেন, তুমি মোটেই দুঃখ করো না বাপি! দুদিন পরে আমরাও তোমার সাথে মিলিত হতে আসব। তুমি খুব সাবধান থাকবে যেন, দাপাদাপি না কর, যেন তোমার আব্বির গায়ে পা লেগে না যায়। তুমি সবসময় মনে রাখবে, তুমি আল্লাহর দিদারে যাচ্ছ। তুমি ধন্য, তোমাকে গর্ভে ধারণ করে আমিও ধন্য।
হযরত ইছমাইল বিললেন, আমার জন্য ভাববেন না আম্মি! আমি ভাবছি আপনার কথা। আপনি যেন আমার জন্য না কাঁদেন। একদিনও চোখের এক ফোঁটা পানি না ফেলেন। তাহলে পরকালে আমার আপনার মাঝখানে চোখের পানির এক অশ্র“সাগর হয়ে যাবে। তা পেরিয়ে আপনার কাছে যাব কেমন করে আম্মি? আমার আব্বি কত কি অক্ষয় কীর্তি করেছেন! নমরূদের ভূতগুলি ভেঙ্গেছেন, নমরূদের অগ্নিকুণ্ড থেকে সুস্থ দেহে বেরিয়ে এসেছেন, মশক বাহিনী নিয়ে নমরূদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর তুলনায় আমি তো কিছুই করতে পারিনি। তবে দুনিয়াতে এটাই আমার গর্ব হয়ে থাকবে আম্মি যে, আমি আল্লাহর নামে উৎসর্গিত হয়ে গেছি।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) খানায়ে কাবায় নামাজ পড়িয়া প্রার্থনা করিলেন, ইয়া আল্লাহ! আমাকে রূহানী শক্তি দাও! আমি যেন ছেলের মায়ায় তোমার নির্দেশ পালনে দুর্বল না হই। কর্তব্য কর্মে পিছপা না হই। ছেলের গলায় ছুরি চালাতে যেন চোখে পানি না আসে, হাত কেঁপে না উঠে।
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর নির্দেশে সকালেই বিবি হাজেরা ছেলেকে গোছল করাইয়া আনিলেন, আতর গোলাপ মাখিয়া সাজাইলেন। উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ পরাইয়া দিলেন। চোখে সুরমা মাথায় তৈল লাগাইয়া দিলেন।
হযরত ইব্রাহীম (আ.)ও সকালেই ছোরায় ধার দিয়া চকচকে করিয়া তুলিলেন। টানিলে পশম কাটিয়া আসে। না! ধারের কোন কমতি নাই।
হযরত ইসমাইল (আ.) সাতবার কাবা তোয়াফ করিয়া আসিয়া প্রথমে পিতা এবং পরে মাতার পায়ে ছালাম করিয়া পিতার সঙ্গে কোরবানী স্থানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইলেন। পিতার সঙ্গে কোরবানীতে চলিয়াছেন, এই জন্য তাহার আনন্দ আর ধরে না। যেমন ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার জন্য এবং খাওয়ার সময় ছেলেরা আনন্দে উৎফুল্লাহ হইয়া উঠে, তেমন।
আজ ১০ই জিলহজ। পিতা চলিয়াছেন পুত্র কোরবানী করিতে।
এমন সময় মক্কার শত শত লোক আসিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে ঘিরিয়া ধরিল। তাহারা বলিতে লাগিল, এমন একটি ছেলেকে আপনি কোরবানী করতে পারেন না। যে ছেলেটি আমাদের মক্কার সকলের আদর-স্নেহের পাত্র, মক্কা আবাদের কেন্দ্রবিন্দু, জমজম প্রাপ্তির ভাগ্যবান শিশু। মক্কার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার চোখের মনি, নয়নের জ্যোতি।
অনেকেই নিজ নিজ পুত্রকে আনিয়া বলিতে লাগিল, মানুষ কোরবানী করাই যদি আল্লাহর নির্দেশ হয়ে থাকে, তবে আমার এ পুত্রটিকে স্বেচ্ছায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আপনার হাতে সমর্পণ করছি। একেই নিয়ে কোরবানী করুন। তবু সকলের প্রিয় ইছমাইলকে রেখে যান।
রাত্রে স্বামী-স্ত্রী মিলিয়া পুত্রকে লইয়া যে সব আলোচনা করিয়াছিলেন, আফসানা শুনিয়াছিল সবই। সেই সকালে যাইয়া মক্কাবাসীকে এই খবর জানাইয়া দিয়াছিল। তাই সবাই ছুটিয়া আসিল হযরত ইব্রাহীম (আ.) সকাশে।
মক্কাবাসীর কথা শুনিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলিতে লাগিলেন, হে আমার প্রিয় মক্কাবাসী! আমি জানি আপনারা আমাকে এবং আমার ছেলেকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসেন এবং স্নেহ করেন। আমার ও আমার পরিবারের বিন্দু পরিমাণ অমঙ্গল আপনারা বরদাস্ত করতে পারেন না। আমি এটাও জানি যে, আমি যখন এখানে ছিলাম না, তখন আপনারাই পরমাত্মীয় হিসাবে আমার স্ত্রী-পুত্রের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, জুগিয়ে ছিলেন শক্তি-সাহস, দিয়েছিলেন মদদ,। কিন্তু আপনারা যে আমার জন্য, আমার ছেলের জন্য নিজ নিজ পুত্রকেও উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, তা দেখে আমি খুবই আনন্দিত যে, আল্লাহর যে কোন নির্দেশ পালনে আপনারা এমনিভাবে উৎসর্গপ্রাণ নিয়ে এগিয়ে আসতে পিছপা হবেন না। আমার মনে হয় যদি আপনাদের উপরেও এমনি প্রাণের বস্তু বা পুত্র কোরবানীর নির্দেশ আসত, যেমন নাকি আমার উপর এসেছে, তবে আপনারা তা-ই করতেন যা আমি করতে যাচ্ছি।
সবাই এক বাক্যে বলিতে লাগিল, আলবৎ! আলবৎ!! আমরাও তা-ই করতাম।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলিতে লাগিলেন, তবে আর আমাকে আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা না দিয়ে বরং প্রস্তুত থাকুন, যদি আল্লাহর কোন নির্দেশ এসে যায় তবে যেন তা পালন করতে কুণ্ঠিত না হন।
জনতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কথা শুনিয়া হৃষ্টচিত্তে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ইব্রাহীমু খালিলুল্লাহ’ বলিতে বলিতে চলিয়া গেলেন।
আর কোন বাধা নাই। হযরত ইব্রাহীম (আ.) হযরত ইছমাইল (আ.)কে লইয়া কোরবানীগাহ বা মিনায় রওনা হইলেন। তখনও মিনা কোরবানীগাহ হয় নাই। শুধু শহর হইতে দূরে এবং নির্জন স্থানে ছেলেকে লইয়া যাওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। মিনা কাবা হইতে তিন মাইল পূর্ব দিকে।
কিছুদূর যাওয়ার পর শয়তান আসিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে পুত্র কোরবানী করা হইতে বিরত করিতে প্রয়াসী হইল। তিনি শয়তানকে লক্ষ্য করিয়া সাতটি কংকর নিক্ষেপ করিলেন। শয়তান দূরে সরিয়া গেল। এইভাবে শয়তান তিনবার হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে প্রভাবিত করিবার চেষ্টা করিল। তিনবারই তিনি সাতটি করিয়া কংকর মারিয়া শয়তানকে তাড়াইয়া দিলেন।
নাছোড়বান্দা শয়তান এইবার লাগিল হযরত ইছমাইলের পিছনে। সে হযরত ইছমাইলকে বুঝাইতে লাগিল, জান খোকা! তোমার পিতা তোমাকে জবাই করে ফেলতে নিচ্ছে। লাশটাও দাফন করবে না। মাঠে ফেলে রাখবে। শিয়াল শকুনে টেনে হিচড়ে তোমার মাংস খাবে।
হযরত ইছমাইল (আ.)ও সাতটি কংকর নিক্ষেপ করিলেন শয়তানকে লক্ষ্য করিয়া এবং বলিলেন, ‘ফা লা’নাতুল্লাহে আলাল কাফেরীন।’
শয়তানের গায়ে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। কিল খাইয়া সে ঢিলের সীমানার বাহিরে গিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। কিন্তু গায়ে আগুন লাগিয়া যাওয়ায় সে চলিয়া গেল বহু দূরে।
কিন্তু ইবলীশ মালাউন যখন দেখিল যে পিতাপুত্র পণে অটল, তাহারা কার্যসিদ্ধি করিবেনই। তখন সে দহন জ্বালা লইয়াই হযরত ইছমাইলের কানে কানে আসিয়া বলিতে লাগিল, কোরবানী একটা ছল মাত্র। তোমাকে ভিনদেশী সওদাগরের কাছে বিক্রি করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
হযরত ইছমাইল (আ.) আবার শয়তানকে গালি দিয়া এবং সাতটি কংকর মারিয়া তাড়াইয়া দিলেন।
কিছুদূর যাওয়ার পর শয়তান আবার আসিয়া বলিতে লাগিল, তোমার বিরহে কেঁদে কেঁদে তোমার আম্মি মরে গেছেন। এইবারও হযরত ইছমাইল (আ.) কংকর মারিয়া এবং গালি দিয়া তাড়াইয়া দিলেন শয়তানকে।
একটি স্থান নির্ধারণ করিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.) থামিলেন, এইখানেই ছেলেকে কোরবানী করিবেন। শয়তান আবার আসিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে কর্তব্যচ্যুত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
তিনি ‘আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার!! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার! ওয়াল্লাহু আকবার!! ওয়া লিল্লাহেল হামদ’ বলিয়া শয়তানকে লক্ষ্য করিয়া ফুঁক দিলেন এবং আরও সাতটি কংকর নিক্ষে করিলেন।
শয়তান এইবার যে ভাগিল পিতাপুত্রের কাছে আর আসিতে পারিল না। তাহার গায়ে তখন আগুনের দহন জ্বালা সর্পের বিষ আর বৃশ্চিকের যন্ত্রণা।
শয়তানকে লক্ষ্য করিয়া পিতাপুত্রের নিক্ষেপিত ৪৯টি কংকরের সেই প্রশংসিত কাজটি আজও ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে হাজী সাহেবান করিয়া থাকেন।
হযরত ইছমাইল (আ.) বলিলেন, আমাকে খুব শক্ত করে বেঁধে নিন পিতা, যাতে আমি হাত-পা ছুড়াছুড়ি করতে না পারি। আপনার পরিধেয় কাপড়গুলিও খুব ভাল করে সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিটা-ফোঁটা তাতে না লাগে। লাগলে হয়ত আমার সওয়াব কমে যেতে পারে। তাছাড়া আপনার কাপড়ে রক্ত দেখলে আম্মির মন খারাব হয়ে যেতে পারে। তিনি বেশী দুঃখ পাবেন। কষ্ট পাবেন। আপনার ছুরিটাও ভাল ধার করে নিন এবং তা আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার মৃত্যু যন্ত্রণা কম হয় এবং সহজেই আমার প্রাণ বেরিয়ে গিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে যেতে পারে।
আপনি আমার আম্মির কাছে যেয়ে আমার ছালাম দিবেন। যদি আমার জামাকাপড় তার কাছে নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন। এতে হয়ত তিনি কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন।
পুত্রের মুখে এমন কথা শুনিয়া পিতার মানসিক অবস্থা কেমন হইতে পারে, তাহা সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) দৃঢ়তার সঙ্গে বলিলেন, বৎস! আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছ। তুমি আমার উপযুক্ত পুত্র।
হযরত ইব্রাহীমের কথা শুনিয়া হযরত ইসমাঈল (আ.) বলিলেন, আপনার বদৌলতেই আমি দুনিয়ার আলো বাতাস পেয়েছি। মায়ের মুখ দেখেছি, মুখ দর্শন করতে পেরেছি আপনার। আল্লাহর দুনিয়া দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তার নাজ-নেয়ামত ভোগ করার ফুরসত হয়েছে। সে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করতে পেরেছি, যে আপনার উছিলায় আমি দুনিয়ায় এসেছি, সেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আপনার হাতেই আমি হচ্ছি উৎসর্গিত। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আমার জন্য আর কী হতে পারে?
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর মনে তখন সাইমুম। তিনি আর বিলম্ব করিলেন না। ছুরিটা আবার পাথরে ঘষিয়া নিলেন। পাথরে পোচ দিয়ো ধার পরীক্ষা করিলেন। পাথর কাটিয়া গেল। ধার ঠিক আছে দেখিয়া তিনি হযরত ইসমাঈলের হাত পা শক্ত করিয়া বাঁধিয়া ফেলিলেন। ছেলের গণ্ড চুম্বন করিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলিলেন, এবার শুয়ে পড় বাপি।


ছাদ্দাকতার রুয়্যা ৩৭ : ১০৩-১০৫
আল্লার হুকুম করতে পালন
হইবে দ্বিধাহীন কেমন,
তার নমুনা গেলেন রেখে
পিতাপুত্র সেই দু’জন!!
আদেশ দেন ইয়া রব রাহীম!
তাই করতে যান ইব্রাহীম!!
লইলেন ছোরা তীক্ষ্ম ধার!
মাটির উপর শুইলেন পুত্র
টান করিয়া ঘাড় তাহার!!
গলার উপর রাইখ্যা ছুরি
দিলেন পিতা তা ঘর্ষণ!! ঐ
এমন সময় আর রাহীম
কন ডাকিয়া- ইব্রাহীম!!
হইলে তুমি মোর খলিল!
সব বুঝিলাম। স্বপ্ন বাস্তব
করলে। রইল ইছমাইল।
এমনিভাবে বদলা আমি
দেই তাকে, যে হয় সজ্জন!! ঐ
হযরত ইসমাঈল মাটিতে শুইয়া পড়িলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রের গলায় ছুরি চালাইয়া দিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য! পশম কাটিয়া যায় যে ছুরিতে, পাথর কাটিয়া যায় যে ছুরির ধারে, সেই ছুরি মানুষের গলা কাটে না। একবার! দুইবার!! তিনবার চেষ্টা করিয়াও হযরত ইব্রাহীম ব্যর্থ হইলেন।
কিন্তু না! ব্যর্থ হইলে চলিবে না। আল্লাহর নির্দেশ পালন করিতেই হইবে। কিন্তু ছুরিতে কাটে না। আমি কী করিতে পারি? এখন উপায়? নবীবর ইব্রাহীম খলীল বোধ হয় সাময়িকভাবে ভুলিয়া গিয়াছেন যে, আল্লাহর যেই নির্দেশে আগুন তাঁহাকে পুড়ে নাই, সেই নির্দেশেই যে তীক্ষ্মধার ছুরি ভোঁতা হইয়া গিয়াছে।
ব্যর্থতার গ্লানিতে তিনি অস্থির হইয়া পড়িয়াছেন। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হইলে চলিবে না। আল্লাহ যেখানে তাহাকে দয়া করিয়া আগুন হইতে বাঁচাইয়াছেন, সেখানে তিনি আল্লাহর কাছে লজ্জিত হইবেন? তিনি আবার ছুরির ধার পরীক্ষা করিতে লাগিলেন।
হযরত ইসমাঈলেরর মন খারাপ হইয়া গেল। এত আশা করিয়া তিনি বাড়ী হইতে আসিলেন, আল্লাহর পথে উৎসর্গিত হইবার জন্য, আর তাহা হইতেছে না। ইহা কি কম বেদনার কথা! তিনি বলিলেন, আব্বি! মনে হয় আমার মুখ দেখে আপনার মনে স্নেহের উদ্রেক হয়। তাতে হাতের শক্তি কমে যায়, তাই জোরে ছুরি চালাতে পারেন না। আপনার চোখ বেঁধে নিন। তাতে স্নেহমমতা আর থাকবে না। সহজেই কার্য সিদ্ধ হবে।
হযরত ইব্রাহীম তাহাই করিলেন। শক্ত করিয়া নিজের চোখ বাঁধিয়া নিলেন। বাম হাতে হাতড়াইয়া পুত্রের গলার অবস্থান বুঝিয়া ডান হাতে জোরছে ছুরি চালাইয়া দিলেন। এইবার গলা কাটিয়া গেল। গরম রক্তে তাহার হাত ভিজিয়া গেল। এইবার কাজ হইল বুঝিয়া তিনি বলিলেন, আলহামদুলিল্লাহ!
গায়েবী আওয়াজ হইল, ‘কাদ ছাদ্দাকতার রুয়্যা’। তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করিয়াছ।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) চোখের কাপড় খুলিয়া ফেলিলেন। ছুবহানাল্লাহ!
তাহার ছুরির নীচে জবাই হইয়া রহিয়াছে একটি হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা। পাশে দাঁড়াইয়া হযরত ইসমাঈল (আ.) হাসিতেছেন।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) তৎক্ষণাৎ দুই রাকাত শুকরানা নামাজ আদায় করিয়া পুত্রকে কোলে টানিয়া লইয়া কপাল চুম্বন করিয়া বলিলেন, তুমি দাঁড়িয়ে গেলে কখন বাপি!
হযরত ইসমাঈল (আ.) বলিলেন, আপনি যখন বাম হাতে আমার গলার অবস্থান বুঝে নিয়ে ডান হাতে গলায় ছুরি বসালেন, অমনি আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। তারপর চেয়ে দেখি আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার স্থানে একটি দুম্বা জবাই হয়ে আছে।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলিলেন, আল্লাহর কুদরত এবং ইচ্ছা বুঝবার মত ক্ষমতা আমার এখনও হয়নি। চল বাপী। এই বলিয়া পুত্রকে কোলে লইয়া তিনি বাড়ীর পথ ধরিলেন।
পুত্রকে সাজাইয়া গুজাইয়া পিতার সঙ্গে বিদায় করিয়া দিয়া বিবি হাজেরা সেই যে গৃহকোণে বসিয়া প্রার্থনায় রত হইলেন, আর বাহির হইলেন না। তিনি দুই রাকাত নামাজ পড়িয়া প্রার্থনা করিতেছেন, ইয়া আল্লাহ! তুমি আমাদের ভুল-ত্র“টি ক্ষমা করে দাও। আমাদের কোরবানীকে তুমি কবুল কর। আমি যেন পুত্র শোকে ব্যথাকাতন হয়ে না পড়ি, বিহ্বল হয়ে না পড়ি। আমাকে ধৈর্য্য ধারণ করার ক্ষমতা দাও। আমার স্বামীর হস্ত-পদ, মন এবং চক্ষুকে কোরবানী করার উপযোগী করে দাও। আমার প্রাণাধিক পুত্রকে তুমি কবুল কর এবং ধৈর্য্যশীল করে দাও।
এমনিভাবে মুনাজাত-প্রার্থনা করিতে করিতে সন্ধ্যা নামিয়া আসিল। তিনি এইবার ভাবিত হইয়া পড়িলেন। এখনও স্বামী ফিরিয়া আসিতেছেন না কেন? তবে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হইয়াছে কি? তবে কি কার্যসিদ্ধি করিতে পারেন নাই? নাকি ছেলের শব বহন করিয়া আনিতে বিলম্ব হইতেছে।
এমন সময় দোরগোড়ায় শব্দ হইল, আম্মি! আমি এসে গেছি।
পাগলিনী মা, মা পাগলিনী! এ পরমপ্রিয় ডাক শুনিয়া পড়ি কি মরি অবস্থায় বিবি হাজেরা ছুটিয়া গিয়া দরজা খুলিয়া পুত্রকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া আলোতে লইয়া আসিয়া চুম্বনে চুম্বনে সিক্ত করিতে লাগিলেন। পাশে দাঁড়াইয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.)। তাঁহার চোখ আনন্দে চিক! চিক!!
বিবি হাজেরা ছেলে বুকে চাপিয়া ধরিয়া রাখিয়াই স্বামীর দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কোরবানী হল না কেন?
হ্যাঁ, হয়েছে। এই বলিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.) সমস্ত ঘটনা খুলিয়া বলিলেন।
বিবি হাজেরা ‘আলহামদুলিল্লাহে হামদান কাছীরান’ বলিয়া আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করিলেন।
আফসানা! তাহার আর তর সহিল না। সে তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া গিয়া মক্কাময় প্রচার করিয়া দিল যে, ইসমাঈল কোরবানী হয় নাই। সে পিতার সঙ্গে ফিরিয়া আসিয়াছে।
ভক্তপ্রাণ মক্কাবাসীরও যেন আর তর সহিল না। তাহারা রাত্রেই ছুটিয়া আসিলেন নবীবর হযরত ইব্রাহীম খলীলের কাছে। জানিতে চাহিলেন সমুদয় ঘটনা।
পুত্র ইছমাইলকে লইয়া মিনা যাওয়ার পথে শয়তান কিভাবে তাঁহাকে এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)কে কর্তব্যচ্যুত করিতে চাহিয়াছিল, কিভাবে কংকর মারিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইল, কিভাবে পুত্রকে কোরবানী করিলেন এবং কিভাবে দুম্বা কোরবানী হইল হযরত ইব্রাহীম একে একে সবাই বিস্তারিতভাবে সকলকে শুনাইলেন।
সব শুনিয়া জনতা উদ্দেলিত হইয়া উঠিলেন, তাহারাও তাহাদের নবীর অনুকরণে দুম্বা কোরবানী করিবেন।
পরের দিন সকালে শত শত ধর্মপ্রাণ জনতা শত শত দুম্বা লইয়া মিনায় চলিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.)ও সকলের সঙ্গে একটি দুম্বা লইয়া চলিলেন। তিনি আজও কোরবানী করিবেন।
জনতাও হযরত ইব্রাহীমের (আ.) নির্দেশিত স্থানে প্রত্যেকেই ৪৯টি করিয়া কংকর নিক্ষেপ করিলেন। তাহারা কোরবানী করিয়া ফিরিয়া আসিলেন।
বিভিন্ন কারণে যাহারা বাদ পড়িয়া গিয়াছিলেন, তাহারা কোরবানী করিতে না পারিয়া দুঃখ করিতে লাগিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাহাদেরকে পরের দিন কোরবানী করিবার নির্দেশ দিয়া ঝুবাইয়া দিলেন ইহাতে ছোয়াব কিছু কম হইবে না।
পরের দিনও বহু লোক কোরবানীর পশু লইয়া মিনায় উপস্থিত হইলেন। হযরত ইব্রাহীমও (আ.) কোরবানীর মানসে একটি দুম্বা সঙ্গে নিলেন এবং সকলকে দেখাইয়া দিলেন কোথায় কংকর নিক্ষেপ করিতে হইবে, কোথায় কোরবানী করিতে হইবে। ভক্তপ্রাণ মুসলমানগণ ভক্তিবিগলিত চিত্তে সকল কার্যক্রম পালন করিয়া মক্কায় ফিরিলেন।


ওয়া ইজ য়ারফাউ ২ : ১২৭-১২৮
হন ইছমাইল সঙ্গী তাঁর
কাবার প্রাচীর বাইতুল্লার
উঠান যখন ইব্রাহীম!
কন রাব্বানা কবুল করুন
আনতাছ ছামীওল আলীম!!
হে রাব্বানা আরজু এই!
করুন মোদের দুই জনেই!!
আজ্ঞাবহ দাস আপনার!
আর আমাদের বংশ হইতেও
করুন আপনার আজ্ঞাধার!!
হইবে তারা আপনার দলে
হইবে খাঁটি যে মুছলীম!!ঐ
কৃপা করে আর শিখান!
হইবে হজের কি আরকান!!
দিন বলিয়া মোদের তাই,
আসুক ফিরে মোদের কাছে
‘তুব আলাইকা’ ওগো সাঁই!!
নিশ্চয়তঃ জানিই মোরা
আনতাত্ তাওয়াবুর রাহীম!!ঐ
সময়ের বিবর্তনে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর বয়স ১১৩ এবং হযরত ইছমাইলের বয়স ১৪ বৎসর হইল। এমন দিনে আল্লাহর নির্দেশ আসিল যেন কাবার ভিত্তির উপর প্রাচীর বা দেয়াল তুয়িা বাইতুল্লাহকে দাঁড় করানো হয়।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) নির্দেশ পালনে ব্রতী হইলেন। পাহাড় হইতে পাথর আনিতে হইবে। তাহা কাটিয়া ঘষিয়া মাজিয়া আয়তাকার, বর্গাকার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আকারের ইট বানাইতে হইবে। সেইগুলিকে পরস্পর জোড়া লাগাইবার জন্য চুনা বা আঠা তৈয়ার করিতে হইবে। তারপর গাঁথিতে হইবে কাবার প্রাচীর বা দেয়াল। তিনি নিজের রাজের কাজ করিবেন বটে, তবে আছে সহকারীর প্রয়োজন, জোগারীর প্রয়োজন, শ্রমিকের প্রয়োজন।
তিনি অনেক শ্রমিক নিয়োগ করিলেন। তাহারা দূর পাহাড় হইতে উপযুক্ত পাথর আনিয়া আকার করিয়া দেয়। চুনাও আসিল। পানি তো আছেই। আয়োজন শেষ। তাই হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাজ শুরু করিলেন। তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন, দেয়াল গাঁথেন, পুত্র ইছমাইল (আ.) জোগান দেন, পিতার হাতে পাথর চুনা পানি তুলিয়া দেন। কাজ চলিল পুরাদমে।
কাবার প্রাচীর এমন উঁচু পর্যন্ত গাঁথা হইয়াছে যে, এখন আর মাটিতে দাঁড়াইয়া তাহার মাথা নাগাল পাওয়া যায় না। হযরত জিব্রাইল (আ.) একটি পাথর আনিয়া দিলেন। এই পাথরে দাঁড়াইয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.) আবার দেয়াল গাঁথার কাজ করেন।
মহান রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় পাথরটি ডাইনে বামে সরিয়া যাইত। ঘুরিতে থাকিত কাবার চারিপাশে প্রয়োজনমাফিক। উপরে নীচে উঠানামা করিত প্রয়োজনমত। চুনা ও পাথর উপরে উঠাইতে হইবে। পাথর নিচে নামিয়া আসিত। হযরত ইছমাইল (আ.) পিতার হাতে তুলিয়া দেন প্রয়োজনমত চুনা ও পাথর। পাথরটি আবার উঠিয়া যাইত হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সুবিধামত স্থানে। এমনিভাবে পাথরটি ঘুরিত কাবার চারিপাশেও। যেন বর্তমান যুগের চলন্ত সিঁড়ি বা লিফট।
পিতা-পুত্র মিলিয়া অক্লান্ত পরিশ্রমে তিন বৎসরে কাবার নির্মাণ কার্য্য শেষ করিলেন। এইবার হযরত জিব্রাইল (আ.) আসিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে বলিয়া গেলেন, জাবালে আবু কোবায়েছের কোন জায়গায় রক্ষিত আছে সেই হাজরে আছওয়াদ। তিনি তৎক্ষণাৎ যাইয়া হাজরে আছওয়াদটি লইয়া আসিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশে কাবার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপন করিলেন। এই জন্য কাবার এই কোণটি ‘রুকনে হাজরে আছওয়াদ’ বা হাজরে আছওয়াদের কোণ বলিয়া পরিচিত।
কাবা বা বাইতুল্লাহ নির্মাণ সম্পন্ন হইল। এইবার পিতা-পুত্র দোয়া করিলেন:-
‘হে মহাজ্ঞানী, শ্রবণকারী আমাদের প্রভু! আমাদের এই খেদমত এবং সেবা আপনি কবুল করুন। হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে আপনার অনুগত বানাইয়া নিন এবং আমাদের বংশধর হইতেও আপনার আজ্ঞাবহ একটি উম্মত বানাইয়া নিন। আর আমাদেরকে শিখাইয়া দিন হজ্জের বিধিবিধান এবং আমাদের প্রতি কৃপা দৃষ্টি রাখুন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবা কবুলকারী এবং মেহেরবান। ২ : ১২৭-১২৮
ইহাই হইল হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দ্বিতীয় দোয়া। এই দোয়ার কিছু অংশ কবুল হইল সঙ্গে সঙ্গেই। হজের বিধান তন্মধ্যে অন্যতম। কাবা বা বাইতুল্লাহকে আল্লাহ কবুল করিয়া নিলেন। তাহার ধারাবাহিকতা এই:-
* হযরত আদম (আ.)-এর নির্মিত কাবা, যাহা দুনিয়ার প্রথম ঘর। যাহা হযরত নূহ (আ.)-এর সময় মহাপ্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল, তাহা আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাহার পুত্র ইছমাইল (আ.)কে লইয়া পুনঃনির্মাণ করেন এবং আল্লাহ তাহা কবুল করেন।
* হাজরে আছওয়াদকে জাবালে আবু কোবায়েছ হইতে আনিয়া কাবায় পুনঃস্থাপন করিয়া কাবাকে বাইতুল মামুরের সমতুল্য করা হইল।
* এহরাম বাঁধা অবস্থায় যেমন ফেরেস্তারা বাইতুল মামুর তোয়াফ করিয়া থাকেন, তেমনি কাবা তোয়াফের পূর্বে এহরাম বাঁধার বিধান হইল।
* এহরাম বাঁধার পর সাতবার কাবা বা বাইতুল্লাহ তোয়াফের নির্দেশ আসিল। তৎসঙ্গে প্রতি তোয়াফে হাজরে আছওয়াদও চুম্বন করিতে হইবে।
এই পর্যন্ত যাহা বিধান হইল, যেমন বায়তুল মামুরের অনুরূপ কাবা, হাজরে আছওয়াদ, এহরাম এবং তোয়াফ, সবই আছমানী স্থাপত্য ও ফেরেস্তাদের অনুকরণ বিধান। ইহার পর হজের বিধান যাহা যাহা প্রবর্তিত হইল, সবই হইল হযরত আদম (আ.) এবং ইব্রাহীম ও ইছমাইল (আ.)-এর বিভিন্ন স্মৃতিচারণ।
* ৯ই জিলহজ্জ। উকুফে আরফা বা আরফায় অবস্থান। ইহা হযরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়ার সাক্ষাত-পরিচয়ের এবং গুনাহ মাফের স্থান ও তাহাদের স্মৃতিচারণ। বিশ্ব মুসলেমীনের গুনাহ মাফের সুসংবাদিত স্থান।
* ছাফা ও মারওয়ায় ছায়ী করা বিবি হাজেরার ছাফা মারওয়ায় পানির জন্য ছুটাছুটি করিবার স্মৃতিচারণ এবং তাহার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠান।
* ১০ই জিলহজ কোরবানী করা হইল হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রিয় বস্তু বা পুত্রকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করিবার শিক্ষা, যাহা এখন কোরবানী অনুষ্ঠানে পরিণত হইয়াছে।
* ১০, ১১ এবং ১২ই জিলহজ পর্যন্ত কোরবানী করিবার বিধান হইল, উম্মতে ইব্রাহিমীর পরবর্তী দিনগুলিতে কোরবানী আদায় করিবার কাজটির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
* কংকর নিক্ষেপ। ইহা হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইছমাইলের (আ.) শয়তানের প্রতি কংকর-ঢিল মারিবার অনুকরণ।
হজের ক্রিয়ানুষ্ঠানগুলি অনুকরণই হউক আর স্মৃতিচারণই হউক, হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাকে জাল্লা শানুহু উপরোক্তভাবে হজের বিধান করিয়া দিলেন, যাহা আবহমান কাল হইতে আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত চলিবে।
তবে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় এবং মজার ব্যাপার হইল এই যে, হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর অপর এক পুত্রের নাম ছিল হযরত ইসহাক (আ.)। তাঁহার পুত্র হযরত ইয়াকুব (আ.)। তাহারই অপর নাম ছিল ইছরাইল। এই ইছরাইলের ছিল ১২ জন পুত্র। ইহারাই বনি ইছরাইল। পরবর্তী সময়ে বনি ইছরাইলরাই হইল ইহুদী এবং খৃস্টান। যেহেতু ইহুদী ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুছা এবং হযরত দাউদ (আ.) ছিলেন বনি ইছরাইলী এবং খৃস্ট ধর্মের প্রবর্তক হযরত ঈছা (আ.)ও ছিলেন বনি ইছরাইলী। এই বনি ইছরাইলীগণ কোনদিনই কাবায় হজ করিতে আসে নাই। যেন বনি ইছমাইলীদের নির্মিত কাবায় আমরা যাইব কেন, এমন একটি ভাব। আমরা যাইব আমাদের বনি ইছরাইলীদের নির্মিত মসজিদ বাইতুল আকছায়। তাই ইহুদী এবং খৃস্টানগণ হযরত ছোলায়মান (আ.) কর্তৃক নির্মিত জেরুজালেমের বাইতুল আকছায় হজ করিতে যাইত। হযরত ছোলায়মান (আ.) ছিলেন বনী ইছরাইলী।
যাহা হউক। হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর সময় হইতেই বনি ইছরাইল এবং বনি ইছমাইল স্বতন্ত্র দুইটি গোষ্ঠী হইয়া পড়ে। তখন হইতেই বনী ইছমাইলীগণই কাবায় হজব্রত পালন এবং কাবার পৌরহিত্য করিয়া আসিতেছে। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও ছিলেন বনি ইছমাইলী। তাই বিশ্বের মুসলমান মাত্রই বনি ইছমাইলী নবীর উম্মত বলিয়া তাহারা কাবাকেন্দ্রীক। সেই গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বটা এখনও রহিয়া গিয়াছে, যাহা কেয়ামত পর্যন্ত চলিবে। তবে আমাদের (মুসলমানদের) পাল্লা এইজন্যই ভারী যে, আমরা ‘আওয়ালা বাইতিও বুজিয়া লিন নাছ’ এই ঘোষণার ঘরকে কেন্দ্র করিয়া আছি।


ওয়াবআছ ফীহিম ২ : ১২৯
কাবা নির্মাণ শেষ করিয়া হাত তুলিলেন ইব্রাহীম!
আমীন! আমীন!! কন ইছমাইল
রাব্বানা ওয়াব আছফী-হিম!!
ইব্রাহীম এবং ইছমাইল!
বলেন আল্লা হে রাব্বিল!!
যারা বংশধর মোদের!
তাদের হতে পাঠান একজন
শ্রেষ্ঠ যিনি রাছুলদের!!
আপনার আয়াত পাঠ করিবেন
তাদের উপর … আলাইহীম!!ঐ
শিক্ষা দিবেন তাদেরকেই!
আপনার কিতাব আসবে যে-ই!!
আর শিখাবেন জ্ঞান-বিজ্ঞান!!
আর তাহাদের পাক করিবেন
হইবে খাঁটি মুসলমান!!
নিশ্চয়ত জানিই মোরা
আনতাল আজীজুল হাকীম!!ঐ
কাবা বা বায়তুল্লাহ নির্মাণ শেষ হইল, হজের বিধি বিধান প্রবর্তিত হইল। দূর-দূরান্ত হইতেও মানুষ হজ মানসে মক্কায় নির্ধারিত সময়ে আসিতে শুরু করিয়াছে। প্রবাসীদের আবাসিক সমস্যা দূর করিবার জন্য গড়িয়া উঠিতে লাগিল সরাইখানাভিত্তিক ঘরবাড়ী, মুসাফিরখানা। গড়িয়া উঠিতে লাগিল নতুন করিয়া আরো হাট-বাজার। কোরবানীর জন্য ব্যবসায়ীরা আমদানি করিতে লাগিল প্রচুর পরিমাণে উষ্ট্র, গরু, ছাগল, মেষ ও দুম্বা।
জিলকদ, জিলহজ ও মহরম এই তিন মাসব্যাপী চলে হজের মৌসুম। এই তিন মাস মক্কা নগরী থাকে গম গম জমজমাট। তেজীভাবে চলে ব্যবসা-বাণিজ্য। মক্কাবাসী এই তিন মাসেই কামাই করিয়া রাখে সারা বৎসরের খোরপোষের অর্থ।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য এবং আল্লাহর ঘরের কাছে থাকিয়া বরকত লাভের আশায়ং আরও বেশী সংখ্যক মানুষ মক্কায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করিতে লাগিল। কালক্রমে বনি ইছমাইলীগণই গ্রহণ করিল কাবার পৌরহিত্য। এরই বদৌলতে তাহারা এবং বংশানুক্রমে পরবর্তীতে কোরাইশগণ হইয়া উঠিল আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভ্রান্ত বংশ। বিখ্যাত কোরাইশ বংশেরই একটি গোত্র হাশেমী বা বনি হাশিম। এই বনি হাশিমেরই অমূল্য বিশ্বরত্ন আমাদের মহানবী।
যাহা হউক। হযরত ইব্রাহীম এবং হযরত ইছমাইল (আ.) কাবা নির্মাণ শেষ করিয়া দোয়া করিলেন:-
হে রাব্বুল আলামীন! আমাদের বংশধরদের মধ্য হইতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাহাদের মাঝে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করিয়া শুনাইবেন এবং তাহাদেরকে আপনার তখনকার দিনের প্রেরিত কিতাব শিক্ষা দিবেন। বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিবেন এবং তাহাদেরকে সমস্ত কলুষতা হইতে পাক-পবিত্র করিবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী এবং বিজ্ঞময়। ২ : ১২৯
ইহা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর তৃতীয় দোয়া। তাহার এই দোয়া কবুল হইল তাহার মৃত্যুর ২৫৫৪ বৎসর পর। এই দোয়ায় প্রার্থিত রাসূলই হইলেন আমাদের প্রিয়নবী, বিশ্বনবী, নবীদের সর্দার, খাতামুল মুরছালীন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)।
তাহার নছবনামা নিম্নরূপ:-
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইবনে আব্দুল্লাহ, ইবনে আব্দুল মোত্তালিব, ইবনে হাশিম, ইবনে আব্দে মান্নাফ, ইবনে কোছাই, ইবনে কিলাব, ইবনে মুররা, ইবনে কাব, ইবনে খুবি, ইবনে গালেব, ইবনে ফিহর, ইবনে মালেক, ইবনে নজর, ইবনে কেননা, ইবনে খুজাইমা, ইবনে মুদরেকা, ইবনে ইলয়াছ, ইবনে মুদার, ইবনে নাজার, ইবনে মাআদ, ইবনে আদনান, ইবনে উদ, ইবনে ছামাআ, ইবনে ছালামান, ইবনে ছাবেত,্ বিনে জমল, ইবনে কায়দোছ, ইবনে ইছমাইল, ইবনে ইব্রাহীম (আ.)।
পিতা-পুত্র প্রার্থনা করিয়াছিলেন, ‘আমাদের বংশধরদের মধ্য হইতে এমন একজন রাসূল দিবেন, যিনি তাহাদেরকে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করিয়া শুনাইবেন।’ এইখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়, তাহারা চাহিয়াছিলেন, ‘একজন রাসূল’ বহুজন নয়। এমন একজন রাসূল যিনি সর্বগুণসম্পন্ন। এইজন্যই দেখা যায় যে, হযরত ইছমাইল (আ.) হইতে আমাদের মহানবী পর্যন্ত সর্বগুণসম্পন্ন হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া আর কোন নবী-রাছুল বনী ইছমাইলে জন্মগ্রহণ করেন নাই। অথচ বনি ইছরাইলে অসংখ্য নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু আমাদের গৌরব এবং গর্বের যে দ্বীন প্রচার করেছেন বিভিন্ন অঞ্চল ও গেত্রের মাঝে তাহাই চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্বব্যাপী কেয়ামত পর্যন্ত প্রচারের জন্য সম্পূর্ণ দ্বীন ও জীবন বিধান হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের মহানবীর দ্বারা। ইসলাম, তৌহিদ এবং একত্ববাদ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। তাই ঘোষণা করা হইল:-
‘আতমামতু আলাইকুম’
দ্বীনের নবীর বিদায় হজে
এই ঘোষণা আরফাতের
দ্বীন ইসলাম আজ পূর্ণ হইল
পাইল সনদ আল্লাহর!!
আজ আরফা দেখল খন!
হইল ব্যস্ত কাফেরগণ!!
দেখল দ্বীনের জয়োল্লাস!
হইল তারা খুবই বেজার
হইল শয়তান খুব নিরাশ!!
করবে মোমিন ভয় আমাকে
করবে না ভয় আর তাদের!!ঐ
আজকে আমি তোদের দ্বীন!
কইমু পূর্ণ আয় মোমিন!!
আর যা ছিল বে-মত মোর!
আজকে আমি তোদের তরে
করেই দিলাম পূর্ণ পুর!!
দ্বীন ইসলামকেই দ্বীন হিসাবে
দেই মনোনয় দ্বীন তোদের!!ঐ
আমাদের মহানবীও বলিয়াছেন, আমি আল্লাহর কছে তখনও নবী ছিলাম যখন হযরত আদম (আ.)ও পয়দা হন নাই। বরং তাঁহার সৃষ্টির জন্য উপাদান তৈয়ার হইতেছিল মাত্র। আমি আমার সূচনা বলিয়া দিতেছি ‘আমি পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়া, ইছা (আ.)-এর সুসংবাদ এবং স্বীয় জননীয়র স্বপ্নের প্রতীক্ষা।’
পিতাপুত্রের দোয়ার ফসল যে আমাদের মহানবী তাহা প্রমাণিত হইল। হযরত ইছা (আ.) বনি ইছরাইলদের বলিয়াছিলেন,
‘ওয়া মুবাশশিরাম বি রাসূলীই য়াতী মিম বাদীছ মুহু আহমাদু।’
আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আসিবেন এবং তাঁহার নাম হইবে আহমাদ।


বালাদান আমিনাঁও ২ : ১২৬
মক্কা এখন হয় জমজমাট
তাই ইব্রাহীম বলেন সাঁই!
এই শহরকে শান্তিধাম আর
বানান নিরাপদ এক ঠাঁই!!ঐ
এই শহরের বাসিন্দার!
ফল মেওয়াতে দিন খাবার!!
রিজিক তাদের দিন প্রচুর
যাদের ঈমান ইয়াওমুল আখের
আর ঈমানদার আল্লাহর
এই সকল আর এই শহরের
জন্য রিজিক শান্তি চাই!!ঐ
বলেন আল্লাহ তখন!
কিন্তু কুফর করবে জন!!
উঠাক ফায়দা অল্প দিন!
তাপর তাদের জোর করিয়াই
করব নরর্ক অন্তরীন!!
ফিরে যাবার স্থান তাহাদের
মন্দ খুবই সন্দে নাই!!ঐ
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর বয়স যখন ১১৬ বৎসর তখন কাবা নির্মাণ শেষ হয়। ইহার পর তিনি আরও ২৪ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন। কাবার নির্মাণ কার্য্য শেষ করিবার পরও তিনি হাতে কলমে, প্রত্যক্ষ্যভাবে উম্মতকে হজ কার্য্য শিক্ষা দিবার জন্য আরও কয়েক বৎসর মক্কায় স্থায়ীভাবে থাকিলেন। তিনি মক্কায় আছেন শুনিয়া দূর-দূরান্তের মুসলমানগণও মক্কায় আসিত, হজ করিত, কতক বা স্থায়ীভাবেই থাকিয়া যাইত।
তাই পরিণত বয়সে তিনি খাছ করিয়া মক্কাবাসীর জন্য দোয়া করিলেন:-
হে আল্লাহ! হে আমার প্রতিপালক! এই শহরকে (মক্কাকে) আপনি নিরাপদ এবং শান্তিধামে পরিণত করুন। এই শহরের বাসিন্দাকে ফল-মেওয়া দ্বারা আহারের ব্যবস্থা করুন। আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি এই শহরের যাহারা বিশ্বাস স্থাপনকারী তাহাদেরকে শান্তি দিন এবং ফল দ্বারা রিজিক দিন।
আল্লাহ পাকে জাল্লা শানুহু বলিলেন, কিন্তু যে ব্যক্তি কুফুরী করিবে, তাহাদেরকে অল্প কয়েকদিনের জন্য সুখ ভোগ করিতে দেয়া হইবে, তাহার পরে বাধ্যগতভাবে তাহাদেরকে নরকাগ্নিতে ঠেলিয়া দেওয়া হইবে। তাহাদের প্রত্যাবর্তনের স্থান খুবই খারাব।
ইহা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কাবা বা বায়তুল্লাহ, নিজের বংশধর এবং মক্কাবাসীর উদ্দেশ্যে চতুর্থ দোয়া। তাঁহার প্রত্যেকটি দোয়াই আল্লাহর দরবারে কবুল হইয়াছে।
তাঁহার দোয়ার ধারাবাহিকতাগুলি লক্ষ্যণীয় বিষয়। প্রথম দোয়ার পূর্বে বিবি হাজেরা এবং শিশুপুত্র ইছমাইলকে সেখানে নির্বাসন দিয়াছিলেন, সেখানে তখন প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত কাবা ছিল। কিন্তু আবাদী মক্কা আর ছিল না। প্লাবনের সময় মানুষও সব গিয়াছিল মরিয়া, ধসিয়াও গিয়াছিল মক্কার সব ঘরবাড়ী। কালক্রমে আবার জনসংখ্যা বাড়িতে লাগিল, বিভিন্ন কাফেলার মুখে মুখে জানাজানিও হইল যে, অমুক জায়গায় বাইতুল্লাহ বা কাবা আছে। তাই সেখানে হঠাৎ দুই একটি কাফেলা আসিলেও মক্কায় বসতি স্থাপনের চিন্তা করিত না। যে কারণে কাবার আশেপাশে হালকা বনজংগল হইয়া গেল। অনাবাদী হইয়া উঠিল বিধ্বস্ত মক্কা।
তাই হযরত ইব্রাহীম (আ.) প্রথমবার দোয়া করিয়া ছিলেন:-
হে আমার রব! আমি আমার বংশধরকে আপনার ঘরের সন্নিকটে এমন একটি ময়দানে স্থাপন করিয়া যাইতেছি, যাহা কৃষি কাজের উপযোগী নহে। তাহারা যেন নামাজের প্রতি খেয়াল রাখে। কিছু সংখ্যক লোককে তাহাদের প্রতি আকৃষ্ট করিয়া দিন। ফল দ্বারা তাহাদের আহার দিন।
অচিরেই দোয়া কবুল হইয়া গেল। দেখা গেল, কিছু কিছু করিয়া বহু লোক পুনরায় প্রাপ্ত জমজম কুপের উছিলায় তাহাদের দিকে আকৃষ্ট হইয়া আবার কাবাকেন্দ্রীক মক্কা গড়িয়া তুলিতে লাগিল। বিভিন্ন স্থান হইতে ফল-মেওয়া আসিয়া মক্কার লোকদের খাবারের সংস্থান করিল।
তাহার চতুর্থ দোয়ার সময় মক্কা নগরী জমজমাট। তাই দোয়া করিলেন যেন মক্কা নগরীকে নিরাপদ এবং শান্তিধামে পরিণত করেন, তাহার বাসিন্দাকে ফল-মেওয়াতে আহার দেয়া হয়। তাহার এই দোয়া কবুল হইয়াছে পরিপূর্ণভাবেই।
মক্কা এক মহা শান্তিধাম। নগরীটি হত্যা-লুণ্ঠন হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত। লুটতরাজ হইতে নিরাপদ। বহিরাক্রমণ হইতে সুরক্ষিত। আজ পর্যন্ত কোনো বিদেশী শাসক শহরটির উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে পারে নাই। মক্কা এবং কাবার ধবংস সাধন ন করিতে আসিয়া ধবংস হইয়াছে আবরাহা নিজেই।
মক্কা কোন উর্বর ভূমি নয়। কোন আবাদ নাই, কোন ফলের বাগানও নাই। কিন্তু মক্কা নগরীতে সারা বৎসরই বিভিন্ন জাতের ফলের যে আমদানী, প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতা তাহা দুনিয়ার আর কোন শহরে বন্দরে দেখা যায় না।
এই সবই হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়ার ফল।
তা ম মা ত

Advertisements

  বর্ণমেলা প্রিন্টার্স এন্ড ক্রেস্ট গ্যালারী আমাদের সেবা সমূহ:- ক্রেস্ট, সম্মাননা স্মারক, মগ, মেডেল, আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড, ক্যালেন্ডার, পোস্টার, পিভিসি ব্যানার, ষ্টিকার সহ সকল প্রকার ছাপার কাজ করা হয় এবং সকল প্রকার সীল তৈরি ও যে কোন অনুষ্ঠানের গেঞ্জী, টিশার্ট প্রিন্ট করা হয়। ঠিকানা: সিডষ্টোর বাজার, ভালুকা, ময়মনসিংহ, মোবাঃ ০১৭১৫২৫৩৩৮৫, E-mail: bornamela03@gmail.com